একটি রাত এবং  কলতান--অনন্যা (ছোট গল্প)

একটি রাত এবং   কলতান--অনন্যা (ছোট গল্প)

    গোলোকেশ্বর সরকার

     দোতলা ছাদের ওপর টবে লাগানো মাঝারি আকারের আম গাছে বাসা করা একটি ভাত-শালিক পাখি বাচ্চা দিয়েছিল। পাখিটি তার দু'টি ডানা দিয়ে বাচ্চাদের ঢেকে নিয়ে আদর করছিল, উষ্ণতা দিচ্ছিল,দুটো ডানা দিয়ে বাচ্চাদের সুরক্ষা দিচ্ছিল। দুপুর বেলা। কলতান ছাদে দাঁড়িয়ে দু'টি ডানা দিয়ে ভাত --শালিকটির সন্তানদের স্নেহ করা, তাপ দেওয়া, নিরাপত্তা দেওয়া মনোযোগ সহকারে দেখছিল। কলতানের শুধু দীর্ঘশ্বাস পড়ছিল। হাহাকার করছিল তার বুকের ভেতরটা। পিয়াসা পেছন থেকে চুপিচুপি এসে কলতানকে গায়ের সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল। কলতান বলল," পিয়াসা, ছাড়ো,ছাড়ো।" পিয়াসা কলতানকে ছাড়ল না। কলতান আবার বলল," পিয়াসা, ছাড়ো। আমি আম গাছে পাখির দুটো ডানা দিয়ে তার বাচ্চাদের পাহারা দেওয়া দেখছি।" পিয়াসা কলতানকে ছাড়ল না। কলতানকে বেশ জোরে জড়িয়ে ধরে পিয়াসা বলল,"বাবা, আমার দুটো হাত দিয়ে তোমাকে রাতের বেলা কঠোর ভাবে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থেকে তোমাকে পাহারা দেব আমি। চুপচুপি তোমাকে পালিয়ে যেতে যেতে দেব না। আমার দু'টি হাত দিয়ে তোমাকে খুব কড়া ভাবে বেঁধে রাখব আমি।"

             বিকেল হলো। ঘরের মধ্যে কাচের পাল্লা দেওয়া আলমারির টেডি--বিয়ারটি দেখিয়ে পিয়াসা কলতানকে বলল,"বাবা, টেডি--বিয়ারটি বের করো। আমি খেলব।" পিয়াসার আবদারে কলতান দেওয়াল আলমারি থেকে নীল টেডি--বিয়ারটি বের করল। কলতান ও পিয়াসা দু'জনে মিলে অনেকক্ষণ ধরে সেই বিয়ারটির সঙ্গে খেলল। অনন্যা এসে খেলাতে যোগ দিল। তিন জন মিলে নীল টেডি--বিয়ারটি নিয়ে খুব,,,খুব খেলল।  

        রাত দশটা বাজল। বিছানায় শুয়ে পড়ল কলতান, অনন্যা ও পিয়াসা। পিয়াসা মাঝখানে। এক দিকে কলতান অপর দিকে অনন্যা। টেডি--বিয়ারটি পিয়াসা তার মাথার পেছনে রাখল। দু'হাত দিয়ে পিয়াসা কলতানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, কলতানকে পিয়াসা মজবুত করে ধরে রাখল। পিয়াসা কলতানকে বলল,"বাবা, তোমাকে আমার দুটো হাতে শক্ত করে ধরে রাখলাম, তোমাকে বেঁধে রাখলাম।" দোতলার ওপর একটি শোওয়ার ঘর। এসি--ঘর। সেগুন কাঠের দামি বক্স--খাট। খাটের ওপর নরম তুলতুলে গদি। গদির ওপর ডলফিনের থ্রি--ডি ছবি আঁকা বিছানার চাদর। নরম তুলতুলে বালিশ। বালিশে মাথা দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল পিয়াসা। পিয়াসা চোখ দু'টি বন্ধ করল। সবে গরম শুরু হয়েছে। ঘরে এসি চলছিল। ঠান্ডা ঘর। অল্প সময়ের মধ্যে গভীর ঘুমে হারিয়ে গেল পিয়াসা।

 

               

                            দুই

     

            কলতান হাইস্কুলের শিক্ষক। বাড়ি-- দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার হরিরামপুরে। চাকরি করে হরিরামপুর থেকে অনেক দূর জলপাইগুড়ি জেলায়। অনন্যাও চাকরি করে। হরিরামপুর হাইস্কুলের দিদিমণি। ছোট পিয়াসা কলতান--অনন্যার একমাত্র মেয়ে। বয়স ছ'বছর। বিয়ের আগে গভীর ভাবে প্রেম করত কলতান ও অনন্যা। প্রেম করার সময় অনন্যা একদিন 'তিস্তা--তোর্ষা কালেকশন' নামে একটি বড় স্টেশনারি দোকানে রোবট যন্ত্রের সাহায্যে ঘর ঝাট দেওয়ার জন্য 'রোবট-- ভ্যাকুয়াম--ক্লিনার' কিনতে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল কলতান। দোকানে বিভিন্ন রঙের বড় আকারের টেডি--বিয়ার রাখা ছিল। টেডি--বিয়ারগুলো দেখিয়ে কলতান অনন্যাকে বলেছিল,"জানো অনন্যা, বিভিন্ন রঙের টেডি--বিয়ার ভিন্ন ভিন্ন বার্তা বহন করে। লাল টেডি--বিয়ার আবেগ এবং ভালোবাসার প্রতীক। গোলাপি টেডি--বিয়ার মানে,উপহার--প্রেরক উপহার--প্রাপকের প্রস্তাবে সম্মত এবং উপহার-- প্রেরক উপহার--প্রাপককে ভালোবাসে। নীল টেড--বিয়ার গভীরতা, শক্তি, প্রজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতির প্রতীক। নীল টেডি--বিয়ার কেউ উপহার দিলে বুঝতে হবে, উপহার দাতা ও উপহার গ্রহীতার মধ্যেকার ভালবাসা সত্যি শক্তিশালী এবং উপহার গ্রহীতা ও উপহার দাতা দু'জনেই এই সম্পর্কের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

সবুজ টেডি--বিয়ারের অর্থ, ভালবাসার সঙ্গে গভীর সংযোগ এবং সেই ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করার বাসনা বোঝায়। কমলা টেডি--বিয়ার আনন্দ, আশা ও আলোর প্রতীক।"

 

        বিয়ের আগে প্রেম করার সময় কলতান অনন্যাকে একটা বড় আকৃতির নীল রঙের টেডি--বিয়ার উপহার দিয়েছিল। টেডি--বিয়ার উপহারে প্রেমিক--প্রেমিকা বহু দূরে থাকলেও টেডি--বিয়ার মাধ্যমে জড়িয়ে ধরে থাকতে পারে একে --অপরের সঙ্গে। অনন্যা কলতানের কাছ থেকে উপহার পাওয়া নরম তুলতুলে নীল টেডি--বিয়ারের স্পর্শ অনুভব করত প্রতিদিন। নীল টেডি--বিয়ারের মাধ্যমে দৈনিক প্রেমের উষ্ণতা গায়ে মাখত। নীল রঙের টেডি--বিয়ারটি যত্ন করে রেখে দিয়েছিল অনন্যা। বিয়ে হওয়ার পর বাড়ি তৈরি করার সময় ঘরের ভেতর একটি কাচের পাল্লার দেওয়াল-- আলমারি বানিয়েছিল তারা। কাচের পাল্লার সেই দেওয়াল--আলমারি মধ্যে সযত্নে নীল টেডি--বিয়ারটি রেখে দিয়েছিল অনন্যা। বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যেত টেডি--বিয়ারটি।  

             কলতান মাসে একদিন জলপাইগুড়ি থেকে বাড়িতে আসে। শনিবার রাতে আসে, রবিবার সারাদিন থাকে, রবিবার রাতের বেলা আবার জলপাইগুড়ি রওনা দেয়। গতকাল শনিবার রাতের বেলা কলতান বাড়িতে এসেছে। কলতান অনেকদিন ধরে হরিরামপুর বা আশপাশে বদলির চেষ্টা করছে। কিন্তু বদলি হচ্ছে না। বারো বছর হয়ে গেল কলতানের জলপাইগুড়িতে চাকরি করা। পিয়াসা বাবাকে খুব ভালোবাসে। কলতান বাড়িতে এলে খুশিতে ভরে ওঠে সে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। কলতানের সাথে বাইকে করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। পিয়াসার মনে তখন খুব আনন্দ। 

কয়েকদিন আগে পিয়াসা অনন্যাকে জিজ্ঞেস করেছিল," মা, এখান থেকে বাবা কখন চাকরিতে যায়?" অনন্যা উত্তর দিয়েছিল,"পিয়াসা, তুমি যখন রাতের বেলা গভীর ভাবে ঘুমিয়ে থাকো, তখন তোমার বাবা চুপিচুপি চাকরিতে চলে যায়।" 

পিয়াসা বলেছিল," মা, সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর বাবাকে দেখতে না পেয়ে আমার খুব খারাপ লাগে। কোনও কিছু ভালো লাগে না। খুব কষ্ট হয়, খুব যন্ত্রনা হয় আমার। বুকের ভেতর খালি আর খালি। বুকের মধ্যে ফাঁকা শুধু ফাঁকা লাগে আমার।"