দয়াল ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

দয়াল ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

কলমে - শিবব্রত গুহ

"আদর্শকে ঘায়েল ক'রে

চুক্তি - রফায় বাঁধতে দল,

যতই যাবি পড়বি ঘোরে

হাতে - হাতেই দেখবি ফল।"

- ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।

অনুকূলচন্দ্র

১২৯৫ সালের ৩০শে ভাদ্র, তালনবমী তিথিতে,

অধুনা বাংলাদেশের পাবনা জেলার হিমাইতপুর

গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবার নাম

ছিল শিবচন্দ্র চক্রবর্তী এবং মায়ের নাম ছিল

মনোমোহিনী দেবী। সাধারণত, জন্মের পরে,

শিশুরা কান্নাকাটি করে। কিন্তু, তিনি কাঁদেননি।

তিনি শান্তভাবে এদিক - ওদিক তাকাতে লাগলেন।

তা দেখে অনেকেই অবাক হয়ে গেল।

ছোটবেলা থেকেই অনুকূলচন্দ্র ছিলেন খুবই

দয়ালু। অন্যের কষ্ট, ব্যথা, বেদনা, যন্ত্রণা তাঁকে সবসময় ব্যথিত করতো। একাধারে, তিনি ছিলেন

মানবপ্রেমী, অন্যদিকে ছিলেন জীবপ্রেমী। মানুষ

ছিল তাঁর প্রাণ। মানুষকে বাঁচাতে তিনি গড়ে তুললেন মানুষের বাঁচা - বাড়ার ঠিকানা সৎসঙ্গ।

এই সৎসঙ্গ হল Man - making industry বা

মানুষ তৈরীর কারখানা।

অনুকূলচন্দ্র জগতের প্রতিটি জীবকে ভালোবাসতেন। তাই, তিনি জীবপ্রেমী। তাঁর বাড়ির কাছেই ছিল স্টীমারঘাট। কোন যাত্রী বা

কুলি বিপদে পড়লে তিনি তাদের বোঝা নিজে

বহন করে তাঁদের সাহায্য করতেন। পয়সা দিতে চাইলে তিনি তা না গ্রহণ করে সেখান থেকে চলে

যেতেন।

অন্যান্য ছেলেদের দেখাদেখি তিনি একদিন

পদ্মানদীতে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে যান। তাঁর

ছিপে একটা বড় মাছ ধরা পড়লো। মাছটা ধরা পড়ে কষ্ট পেল বা মরে যাবে মনে করে তিনি কেঁদে

ফেললেন। মাছটা ছেড়ে বাঁচিয়ে দেবার জন্য উপস্থিত সবাইকে অনুরোধ করতে লাগলেন।

তখন তারা মাছটি ছাড়িয়ে জলে ছেড়ে দেবার পর

তিনি শান্ত হলেন। তারপর, আর কখনো তিনি

এরকম কোন কাজ করেননি।

তিনি একদিন, বিদ্যালয় থেকে বাড়ীফেরার সময়,

হঠাৎ করে ভয়ানক ঝড়বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টি শুরু হল।

ছাত্ররা যে যার সুবিধামতো জায়গায় আশ্রয় নিল।

কিন্তু, অনুকূলচন্দ্র ওই দুর্যোগের মধ্যে রাস্তা দিয়ে

চলতে শুরু করলেন। চলতে চলতে, কোথা থেকে

ঝড়বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত প্রায় মৃত একটি বাজপাখি

তাঁকে দেখতে পেয়ে তাঁর কাঁধে বসে প্রাণরক্ষা

করলো। তিনি ধীর - স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন।

একটু নড়লেন না, চড়লেনও না। যতক্ষণ না

বাজপাখিটা সুস্থ হয়ে সেখান থেকে চলে না গেল।

সত্যিই অসাধারণ জীবের প্রতি দয়া ছিল অনুকূল

চন্দ্রের।

অনুকূলচন্দ্র ডাক্তারী পাশ করার পরে, অনেক

রোগীকে রোগমুক্ত করেন। বহু গরীব - দুঃখী

মানুষকে তিনি দাতব্যভাবে চিকিৎসা করতেন।

অর্থের অভাব আছে এমন রোগীর পথ্যও তিনি

কিনে দিতেন। তাঁর সামনে কেউ মারপিট করলে

বা কেউ কোন মানুষকে বা পশুকে আঘাত করলে

অথবা কেউ কারো ওপর নির্যাতন করলে

তিনি খুবই যন্ত্রণা অনুভব করতেন। কখনো কখনো তাঁর সামনে এরকম ঘটনা ঘটলে, তিনি

কেঁদে আকুল হতেন। কখনো তাঁকে ধুলায়

গড়াগড়ি খেতে দেখা গিয়েছে।

তাঁর সামনে কোন গাছের ডাল ভেঙে পড়লে বা

পাতা ছিঁড়লে অথবা ফুল তুললে তিনি প্রাণে

বড় ব্যথা পেতেন। গাছেদের শরীরে ওগুলো করলে যে ব্যথা হয়, তা তিনি অন্তরে অন্তরে

অনুভব করতেন। তিনি দিব্যদৃষ্টিতে তা দেখতেও

পেতেন। তাই, তিনি ফুল না তুলে, গাছকে জড়িয়ে

ধরে ফুলের সৌরভ নিয়ে আনন্দ উপভোগ করতেন।

যে কোন জীব, কীট, পতঙ্গ, পিঁপড়ে এমনকি

ছারপোকা, মশা পর্যন্ত তিনি কখনো মারেননি,

বা অন্য কাউকে ওরকম করতে দেখলে তিনি তা

সহ্য করতে পারতেন না। ধীরে ধীরে সকলে তাঁকে

ভালোবেসে ও ভক্তি করে 'ঠাকুর' বলে সম্বোধন

করতে লাগলো। আর ডাক্তার বাবু বলে বা নাম

ধরে তাঁকে ডাকতে কেউ রাজি ছিল না। কিন্তু,

অনুকূলচন্দ্র, ঠাকুর হওয়া একেবারেই ভালোবাসেন না, পছন্দও করেন না। কেউ ঠাকুর

বললে তিনি অস্বস্তি বোধ করতেন। তবে, সকলেই,

ঠাকুর বলতে বলতে সেটি তাঁর সহ্য ও অভ্যস্ত হয়ে

গেল।

অনুকূলচন্দ্র, অনেক সময় কারো - কারো শরীরে,

মাথায় ও পায়ে স্নানের সময়, তেল মাখিয়ে দিতেন। কখনো তিনি তামাক সাজিয়ে দিয়ে

ভক্তের ধূমপানের সাধ মিটিয়ে দিতেন। কখনো

কেউ অনেক দূর থেকে এলে তার পায়ে ব্যথা অনুভব করলে অনেক সময় অনুকূলচন্দ্র

নিজের হাতে তার পা টিপে দিতেন। তিনি ছিলেন

এতটাই দয়ালু।

তিনি বললেন, " ভারতের অবনতি ( degeneration) তখন থেকেই আরম্ভ হয়েছে,

যখন থেকে ভারতবাসীর কাছে অমূর্ত্ত ভগবান

অসীম হ'য়ে উঠেছে - ঋষি বাদ দিয়ে ঋষিবাদের

উপাসনা আরম্ভ হয়েছে।"

অনুকূলচন্দ্র সারাজীবন ধরে অন্যের কল্যাণের

কথা ভেবেছেন। সবাই ছিল তাঁর কাছে আপন।

পর বলে তাঁর জীবনে কেউ কোনদিনও ছিল না।

তারপর এল সেই কষ্টের দিন। ১৯৬৯ সালের

২৭শে জানুয়ারী জীবপ্রেমী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

দেহত্যাগ করেন। তিনি নশ্বর দেহ ত্যাগ করলেও

আজো তিনি জীবন্ত রয়েছেন প্রতিটি সৎসঙ্গী

গুরুভাইবোনদের হৃদয়ে হৃদয়েশ্বর রূপে।

তথ্য সংগৃহীত