অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছি: প্রধানমন্ত্রী

বাংলাভাষী ডেস্কঃঃ

একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার (৬ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ বছরের শেষে অথবা সামনের বছরের শুরুতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এখন থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী, ক্ষমতালোভী, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনকারী আর পরগাছা গোষ্ঠীর সরব তৎপরতা শুরু হয়েছে। এদের লক্ষ্য ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পেছনের দরজা দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। গণতন্ত্রেও অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে একটানা ১৪ বছর আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এই ১৪ বছরে আমরা দেশ এবং দেশের জনগণকে কী দিতে পেরেছি, তার বিচার-বিশ্লেষণ আপনারা করবেন। বর্ষপূর্তিতে আমি শুধু কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করে আপনাদের স্মৃতিকে নাড়া দিতে চাই।’

নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে ‘রূপকল্প-২০২১’ প্রণয়নের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠনের পর সেই ইশতেহারের আলোকে আমরা আশু করণীয়, স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করি।’

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘স্থবির অর্থনীতিকে সচল করতে শুরুতেই কৃষি, জ্বালানি, বিদ্যুৎসহ কয়েকটি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা কাজ শুরু করি। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কয়েকটি ছোট বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করি। খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমরা মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই রাসায়নিক সারের দাম কমিয়ে দেই। এরপর আরও দু-দফায় সারের দাম হ্রাস করে কৃষকের ক্রয় ক্ষমতার আওতায় আনা হয়। এমনিভাবে প্রতিটি খাতে আমরা পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেই।’

‘রূপকল্প ২০২১’ সালের পর ‘রূপকল্প ২০৪১’ এবং ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ প্রণয়নের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রূপকল্প ২০২১-এ আমরা অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলাম। আজকে সন্তুষ্টচিত্তে বলতে পারি, আমরা সে প্রতিশ্রুতি পূরণে সক্ষম হয়েছি। রূপকল্প-২০৪১ লক্ষ্য হচ্ছে- ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করা। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর লক্ষ্য হচ্ছে- জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে একটি টেকসই উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখা।’

সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার সুফল জনগণ পেতে শুরু করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায়। নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্ধিত চাহিদা মেটানোর জন্য আমরা এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করে এলএনজি আমদানির ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত আজ মধ্যবিত্ত-নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে গ্যাসের চুলায় রান্না হয়।’

বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্পন্ন করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই সেতু দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলাকে সড়ক পথে ঢাকা এবং অন্যান্য জেলার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করেছে। গত ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আমরা যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরেকটি মাইলফলক স্পর্শ করেছি। কিছুদিনের মধ্যেই শুধু বাংলাদেশেই নয়, চট্টগ্রামে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পাতাল সড়কপথ- বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের মাধ্যমে আরেকটি মাইলফলক স্থাপিত হবে। পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। আমরা ২০১৮ সালের মে মাসে মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করেছি।’

স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাসহ দেশের মহৎ ও বৃহৎ অর্জন আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরেই অর্জিত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করি মহান স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের মাধ্যমে অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর দ্বারপ্রান্তে, তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি তাকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করে। স্তব্ধ হয় বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়। ১৯৯৬-২০০১ সাল এই ৫ বছরে দেশের প্রতিটি খাতে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়। বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ১১ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করে স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেই।’

২০০১ সালের ‘প্রহসনের নির্বাচনে’ জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় এসেছিল মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওই সরকারের ৫ বছর ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। হত্যা-গুম, ধর্ষণ, লুটপাট, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো এবং জঙ্গিবাদের লালন-পালনসহ অপশাসন-কুশাসনে জোট সরকার যে মাইলফলক স্থাপন করেছিল, এ দেশের মানুষ আগে কখনো তা দেখেনি।’

‘ওই সময় শুধু আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওই সময় অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়ে। মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস, সাক্ষরতা হ্রাস, জনজীবন দুর্বিষহ করে তোলে।’

চার-দলীয় জোট সরকার মেয়াদ শেষে ‘নানা কূটকৌশলের আশ্রয়’ নিয়ে স্বাভাবিক ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভোটার তালিকায় ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার ষড়যন্ত্র করে বিএনপি। দলীয় রাষ্ট্রপতিকেই প্রধান উপদেষ্টার পদ দিয়ে সরকার গঠন করে ৬ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে প্রহসনের উদ্যোগ নেয়। জনগণ তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।’

অরাজক পরিস্থিতির মুখে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘তারাও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে শুধু ব্যর্থই হয়নি, নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কালিমালিপ্ত করে। তবে শেষ পর্যন্ত সেই সরকার ছবিসহ একটি সুষ্ঠু ভোটার তালিকা তৈরি এবং স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সসহ নির্বাচনী সংস্কার সম্পন্ন করে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।’

ভাষণের শুরুতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের চার বছরপূর্তি উপলক্ষে এবং ইংরেজি নতুন বছরে দেশবাসী এবং প্রবাসীদের শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম জানান তিনি।

এ ছাড়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নিহত, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত এবং ২০১৩-২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের অগ্নিসন্ত্রাস এবং পেট্রোল বোমা হামলায় নিহতদের স্মরণ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে আহত ও স্বজনহারা পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত মারা যাওয়া রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।