অহমিকা

অহমিকা

তাহমিনা চৌধুরী 

আজ সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম। নিজের ঘরের কাজের সাথে সাথে আমাকে মাঝে মাঝে অন্যের কাজ করতে হয়। সম্প্রতি ছোট ছোট কথা বার্তা নিয়ে আমার পাশেই আরেকটি বাঙালি পরিবার প্রায় ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হলো। সেই সংসার যাতে ভেঙে না যায়, সেজন্য আমার প্রাণপণ চেষ্টা ছিলো আজ সারাদিন। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম একটি সংসারকে যেভাবেই হোক জোড়া লাগাতে হবে। 

এই তো! আমাদের পাশেই থাকেন উনারা। সবসময় যাওয়া আসা চলে আমাদের মাঝে। আমরা একই দেশের মানুষ হলে ও দুই শহরের। আমার বাড়ি সিলেট আর উনাদের বাড়ি কুমিল্লা।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া লেগে থাকতো। কখনো টাকাপয়সা, কখনো'বা আত্মীয় স্বজনের অতি মাত্রার কথাবার্তা নিয়ে। কখনো বা নিজ ঘরে পান চুন কষতেই--, 

আজ তাদের ঝগড়ার মাত্রা তুমুল আকার ধারণ করলো। সাথে সাথে ঐ পরিবারের বড়ো মেয়েটি ফোন দিয়ে বললো,,, 

খালা মণি, খালা মণি, তাড়াতাড়ি আসেন।

মা-বাবার ঝগড়া আর ভালো লাগতেছে না, তাদের ঝগড়াঝাঁটি দেখতে দেখতে, আমার না'--- মরে যেতে ইচ্ছে হয়।

আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, এভাবে বলো না মা,---আমি আসছি। 

তড়িঘড়ি করে তাদের বাসায় গেলাম।

আমাকে দেখেই (স্বামী) ভাইটি ও চুপচাপ,,,, (স্ত্রী) বোনটিও চুপচাপ। 

বললাম কি আপা,,,, কি হলো?

এখন কোনো কথাবার্তা বা সাড়াশব্দ নেই কেনো?ভাইয়াকে দেখলাম নিরবে হাত-বেগে উলটপালট করে কাপড় ডুকাইতেছেন। 

তা দেখে আমি বললাম, কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া? তিনি এক শব্দে উত্তর দিলেন,, আপা আর পারছি না! আপনার এই বোনটি'কে আমি ডিভোর্স দিবো। তাকে আর,সইতে পারছি না।

এ কথা শুনা মাত্রই আমি চমকে উঠলাম। বার বার দু'জনকেই বুঝাতে চেষ্টা করলাম। আগে একটু শান্ত হও। দু'চারটা কথা শুনি। তারপর তুমি তোমার সিদ্ধান্ত নিও। 

মিনিট পাঁচেক পরেই তারা দুজনেই একই সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে লাগলেন। 

তাৎক্ষণিক একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম তাহলে আমি কি চলে যাবো। 

নিজেকে ক্ষানিকটা ব্যর্থ মতোমরা যদি তোমাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকো, তাহলে এখানে আমার আর কোনো দরকার নেই। তোমাদের যা খুশি তাই করো। 

এই বলে দাঁড়াতেই ভাইয়া বললেন,, সে তার সিদ্ধান্তে অটল। একত্রে আর থাকবে না।

আমি প্রশ্ন করলাম, তোমাদের তিনটি সন্তান আছে, দুটো মেয়ে একটি ছেলে এদের কি হবে? 

বড়ো মেয়েটির বয়স ২১, তারপর ছেলের বয়স ১৭ আর ছোট মেয়ে ১৩ বসর।

ভাইয়া তড়িঘড়ি করে বললেন— ওরা তো তাদের মা'র কাছেই থাকবে। 

আমি বললাম আপনার কথাগুলো সঠিক নয়! এই সন্তান গুলো কি আপনার না? আপনি এভাবে বলছেন কেনো?

দাঁড়াও --

চুপ--- একদম চুপ,,, ওখানে গিয়ে বসেন। আমি একজন একজন করে দুজনেরই কথা শুনবো। তারপর আমি কিছু বলবো, তারপর সেটা যদি তোমাদের পছন্দ না হয়, তাহলে তোমরা যা খুশি তাই করতে পারো। 

এবার দু"জন চুপ থাকলো এবং দুজনের সম্মতি দিলো,,

জ্বি আপা জ্বি আপা--- 

আপনি যা বলবেন তা শুনবো। বলেন আপা বলেন, আপনার কথা শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। 

তারপর,,, একাধারে তিন ঘন্টা নানান ভাবে আলোচনা হলো, দুজনেরই কথা শোনা হলো, আমার মনে হলো দুজনার মধ্যে ভুল আছে,, আবার দুটি পয়েন্টে ঠিক আছে। সে কথা আর লিখলাম না। 

অতঃপর,, 

উভয়কে বুঝানোর পরও এ বেলা ঐকমত্যে আসা সম্ভব হয়নি। 

তারপর বললাম দেখো,, আমার কিছু তাড়া আছে। ছেলেমেয়েরা আসার সময় হয়ে যাচ্ছে। তোমরা যদি আমার কথা শোনো, আমার বলতেও ভালো লাগবে, আর তোমাদের ও মঙ্গল হবে। 

আর যদি নিজের কথা নিজেরাই অটুট থাকো, তাহলে আমার এখানে দরকার কি? 

মনে মনে রাগ হলো।

স্ত্রী দিকে চোখ তাকিয়ে বললাম,কি গো তোমার কিছু থাকলে বলো?

ভাইয়া আপনি কিছু বলবেন?

নতুবা আমি যাই।

দু তিন মিনিট পর উভয়ই আনমনা ছিলেন এবং পরক্ষণেই সম্মতি দিলেন, 

বলুন আপা বলুন,,, 

বললাম প্রথমত আপনারা কথায় কথায় ঝগড়া করা বন্ধ করুন। এসব কথা শুনতেও আমার রুচিতে বাঁধে। 

আল্লাহ আপনাদেরকে তিনটি সন্তান দিয়েছেন, এই তিনটি সন্তানকে সুন্দর একটি সংসার তথা মিলমিশ পরিবেশ যদি না দিতে পারেন, তাহলে তাদের কাছ থেকে মা-বাবা ডাক শোনার আগ্রহ কেনো হয়েছিলো ? আপনাদের অহমিকার জন্যই এই সরলমনা সন্তানদের ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার ।দুঃখিত ভাই,,দুঃখিত বোন,,,,এটা মোটেই কাম্য নয়।

উচ্চস্বরে এই কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে আমি তাদের শুনিয়ে দিলাম।

ছেলেমেয়েরা মা-বাবাকে সমান ভাবে ভালোবাসে। মা-বাবা দুজনকেই তাদের প্রয়োজন। 

তারপর বললাম শোনো;

আজ থেকে দু'জনেই একটা কাজ করো, আপনারা যে টাকা ইনকাম করবেন, সেই টাকা একই অ্যাকাউন্টে রাখবেন। এখান থেকে সংসারের যাবতীয় খরচ পাতি বহন করবেন। আলাদা করে অ্যাকাউন্ট রাখা যাবে না। একজনে গ্রোসারি আর একজনের রেন্ট এবং কাউন্সিল টেক্স----

এভাবে প্রয়োজনীয় সব কিছু এক একাউন্ট থেকে খরচ হোক,, অবশেষে যা থাকলো তা হবে দু'জনের ভবিষ্যতের কাণ্ডারী। 

আল্লাহ আপনাদের পরিপূর্ণ একটা সংসার দিয়েছেন। এখানে আপনার কামাই আর তার কামাই মধ্যে আলাদা দেখছেন কেনো? স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একে-অন্যের পরিপূরক। 

বেশ কিছুক্ষন ওরা অংক কষতে লাগলো। আমি বললাম হেরে বোকা—

স্বামী ছাড়া যেমন স্ত্রী অপূর্ণ তেমনি স্ত্রী ছাড়াও স্বামী ও অপূর্ণ। 

আর সন্তানের জন্য মা-বাবা উভয় ছাড়াই সন্তান অপূর্ণ। 

এই বলে ঘর হতে বাহির হবো। ঠিক এই মুহুর্তে স্বামী স্ত্রী আমার কাছে এসে বললেন, আপা দাঁড়ান,, 

এভাবে যাবেন না,,, 

আপনি সঠিক বলছেন আপা। আমরা এভাবে ভাবিনি। আপনার কথাটি আমরা বুঝতে পেরেছি।

আমরা উভয়ই অর্থবিত্তের অহংকার লালন করছি কিন্তু ছেলেমেয়ের দিকে খেয়াল করতে পারিনি।

কিছুক্ষণ বাসার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মনে মনে চিন্তা করলাম---

আমি আরও কিছুক্ষণ রাগ দেখাই। তাৎক্ষণিক ওরা পিছু পিছু এসে আপা আপা বলে ডাকতে লাগলো। তারপর পূণরায় বাসায় গেলাম,বলতে লাগলাম, আরে পাগলেরা-- 

ভালোমন্দ মিলিয়েই তো পরিবার।

নিজের স্বার্থ না দেখে অন্ততপক্ষে সন্তানদের কথা চিন্তা করে তোমাদের নমনীয় থাকা উচিত ছিলো। সন্তানরা তোমাদের দেখেই অনেক কিছু শিখবে। পরিবার থেকে অনেক শিখার আছে যা বাহির হতে শেখা যায় না। তোমরা অযথা শুধু শুধুই ঝগড়া করে তাদের মনে কষ্ট দিতেছো। 

তারপর কিছুক্ষণ দু'জনই চুপচাপ থাকলো---

আমি বললাম,, আর কোনো সমস্যা? 

উত্তরে দু'জনই বললো, না আপা না,, আর কিছু না।

সরি আপা,, 

আজ আমাদের ভুল ধরা পড়েছে। 

আমি বললাম

আসলেই কিছু মা-বাবা নিজের ভালো লাগাকেই প্রাধান্য দিতে গিয়ে সংসারে মন্দ ভাব তৈরী করেন। এতে সন্তানদের কচি মনে বিরাট আঘাত আসে।ধীরে ধীরে ভেঙে যায় পরিবার। সন্তানেরা অসহায় হয়ে পড়ে। তারা শান্তি খোঁজে কখনো মায়ের কাছে,কখনো'বা বাবার কাছে খোঁজে স্বস্তি।কিন্তু শান্তি কি পায় কোথাও!সন্তানদের কোনো একুলই থাকে না। 

দুখ সুখ, ভালোমন্দ মিলিয়ে পরিবার। অন্ততপক্ষে সন্তানদের সুখের একটা পরিবেশের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা এসব মা-বাবার উচিত। চেষ্টা করার পর একেবারেই বনিবনা না'হলে ভিন্ন কথা।

যেতে যেতে বললাম, তোমরা দুজনেই আমাকে "আপা"ডাকো। অতএব আপার শেষ আবদার„ ছোট ছোট বিষয়ে নিয়ে আর যেন ঝগড়া না শুনি। 

ভালো থাকো তোমার। ভালো থাকিস মা মণিরা আমি গেলাম।