আমরা কি আদিম যুগে ফিরে যাচ্ছি?

আমরা কি আদিম যুগে ফিরে যাচ্ছি?

শেখ মাহমুদ আল রাফসান 

অর্থনীতি বিভাগ (চতুর্থ বর্ষ)

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 

অতি প্রাচীন কালে মানুষ যখন বনে জঙ্গলে কিংবা গুহায় বসবাস করতো, তখন তাদের জীবন ছিলো অনেক টা বন্যপ্রাণীর মতো। দলবদ্ধ হয়ে তারা থাকতো এবং ক্ষুধা নিবারণের জন্য গাছের ফলমূল এবং শিকার করা প্রাণীর মাংসের উপর নির্ভরশীল ছিল। অতিরিক্ত খাদ্য দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় তাদের চাহিদা বা ক্ষুধা অনুযায়ী ই খাদ্য সংগ্রহ করত। 

সময়ের পরিক্রমায় মানুষ এখন অনেক বেশি আধুনিক। জঙ্গলের সেই গুহা ছেড়ে এখন তাদের আবাস আকাশচুম্বী দালান। খাদ্য বা অন্যান্য সম্পদ দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণের উপায় আবিস্কৃত হয়ে যাওয়ায় মানুষের চাহিদার রেখা এখন উর্ধ্বমুখী। একটা পর্যায় পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতা সমাজের জন্য উপকারী হলেও মানুষ এখন এটিকে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা বানিয়ে ফেলেছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্বের একপ্রান্তে যখন অতিরিক্ত খাদ্যদ্রব্য সাগরে ফেলে দেয়া হচ্ছে, আরেক প্রান্তে দুর্ভিক্ষের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে বহু আদমসন্তান। 

তবে খাদ্য বা সম্পদের প্রতি এই তীব্র ক্ষুধার তাড়নার চেয়েও ভয়ঙ্কর হল মানুষের যৌন আকাঙ্ক্ষা। এদিক থেকে অবশ্য আদিম মানুষের সাথে আধুনিক মানুষের মিল পুরো ষোল আনা। প্রাচীন শিলালিপিতে বা গুহায় চিত্রকর্ম গুলো তে যেভাবে চিত্রিত আছে, সেই আদিম রূপেই তা বারবার ফিরে ফিরে আসছে। যার ফলে লজ্জার মুখে পড়ছে মানবসভ্যতা, যেটিকে নিয়ে মানুষ বড়াই করতো। একদিকে মানুষ যখন এলিয়েনের খোঁজে ভিনগ্রহে পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে এবং সেই পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়ন হয়ে যায়, তাদের সামনে মানুষের মাথা নিচু হয়ে যাবে। কারণ আমাদের বড়াই করা সভ্যতায় আমরা সভ্য মানুষ তৈরি করতে পারিনি। বন্যপ্রাণী যেমন তার যৌন লালসা নিবৃত করতে পারেনা - বিপরীত লিঙ্গের কাউকে পেলেই ঝাপিয়ে পড়ে, কেতাদুরস্ত পোশাক পরা সভ্য মানুষের বাহ্যিক আবরণ ই বদলেছে - ভেতরে ভেতরে কোথাও সেই আদিম মানুষ রয়েই গেছে। 

করোনাকালে যখন আমাদের মানবিক আচরণ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো, সেই সময়ে মানুষ নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি বরং আরও বেয়াড়া ভাবে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। গত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো তে বারবার ধিক্কারের শিকার হয়েছে মানবসভ্যতা। বৃদ্ধা থেকে শুরু করে স্কুল পড়ুয়া কিশোরী - সমাজে নিরাপদ নয় কেউ-ই। এতে করে অলিখিতভাবে সমাজে একটি অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি সেটি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই কারও মধ্যে। একের পর এক ঘটনায় মানুষ প্রতিবাদ করছে, বিচার চাইছে - আবার ঘুরেফিরে তারাই সেই অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। কোথায় যাচ্ছি আমরা?

 মানবিকতার চরম অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে এখন আমাদের উল্টো দিকে ফিরে তাকাতে হবে।। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে যদি অল্প বয়সেই বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি বিরূপ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে একটি সুস্থ সম্পর্ক কখনোই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বিশ্বাস যখন একবার ভেঙে যায়, সেটি পুনরায় গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব, কিন্তু এই অসম্ভব টা-ই আমার সম্ভব করে তুলতে হবে - অন্তত মানবসভ্যতার জন্য হলেও। পাশবিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নারী পুরুষের আগেও আমাদের যে মানুষ নামক আরেকটি পরিচয় রয়েছে সেটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটির শুরু করতে হবে একেবারে পরিবার থেকে এবং নিশ্চিত করতে হবে যেন শেষ না হয়। মানুষ পরিচয়টি বদ্ধমূল হওয়ার আগপর্যন্ত এই কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হবে। আমাদের এখনো মানুষ হয়ে ওঠাই বাকি - নাহয় সব অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। 

মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রায় দুই লক্ষ মা-বোন পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের সেই ত্যাগে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু সেই স্বাধীন দেশেও যদি নির্যাতিতা দের উত্তরসূরীরা নির্যাতনের শিকার হতে থাকে তবে আমাদের স্বাধীনতার সেই গর্ব অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় - যেটি কোনো ভাবেই কাম্য নয়। সবার মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। মন টা আধুনিক করলেই দেশ আধুনিক হবে। মরচে পড়া পুরনো মানসিকতা নিয়ে থাকলে মানবিক বোধহীন রোবট তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবেই। তাই সবার আগে প্রয়োজন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, মানসিকতা উন্নত করা। নাহয় নিকট ভবিষ্যতেই মানবসৃষ্ট রোবট পুরো পৃথিবী দখল নিয়ে আমাদের বাস্তুচ্যুত করে পাঠিয়ে দেবে জঙ্গলে, ওহ্ সেই জঙ্গল ও তো আমার ধ্বংস করে ফেলেছি। ভবিষ্যতে তাহলে আমরা গিয়ে দাঁড়াবো কোথায়??