আবুলের কুরবানি
আবুলের অবস্হা এখন আগের মত নেই। খড়ের চালার ভাংগা বাড়িটার জায়গায় উঠেছে টিনের ঘর। বাঁশের বেড়া সরিয়ে সেখানে পাঁচ ইন্চি ইটের গাঁথুনিও দেয়া হয়েছে। একটা মটর সাইকেলও কিনেছে আবুল নতুন বাড়িটার অাভিজাত্য বাড়াতে।
শোবার ঘরের শেষে গরু রাখার একটা ঘর, সেটাও ইটের । এখানেই আবুলের বৌ সখ করে এক এঁড়ে বড় করছে, ইচ্ছে ছেলের আকিকা আর কুরবানী একই সাথে দেওয়া। বড়ই আদরের শ্যামলা সাদায় মেশানো এঁড়েটা।
এবার ওর বযস তিন বছর। ওর তেল চকচকে গা,নাদুস নুদুস চেহারা থেকে চোখ ফেরানো যায় না।
বৌ এর চেয়ে বেশি ভালবাসে আবুল তার এঁড়ে টাকে। ছেলে আব্দুর রহিমের বয়সও তিন বছর, আবুলের কাছে দু'জনের প্রতি স্নেহ ভালবাসা সমান্তরাল। ছেলেকে কোলে নিলে গরুটার কাছে যেয়েও তার গলা চুলকিয়ে দেয়। বাইরে গেলে ছেলের জন্য এক প্যাকেট বিস্কুট আনলে গরুটার জন্য ও আনে দাদাদার খৈল,নালীগুড় যা গরুটার অতি প্রিয়।
সখ করে আবুল এর নামও রেখেছে ছেলের নামের সাথে নাম মিলিয়ে ফহিম।
ফহিম, অন্যদের কাছে বড়ই বেপোরোয়া,বাইরে নিলে তাকে ধরে রাখে এমন সাধ্য কারো নেই, কিন্তু আবুলকে সে মান্য করেই না, প্রতিটি কথা সে বুঝতে পারে।
আবুল তার সখের মটর সাইকেলটা নিয়ে বাড়ির বাইরে গেলেই ফহিম, হাম্বা ডেকে জানিয়ে দেয়, সাবধানে যেও। রাতে ফিরতে দেরি হলে হাম্বা ডাকা শুরু করে।
দূরে আবুলের বাইকের শব্দ পেলেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে। ডাকতে থাকে।
আবুলের বৌএর ইচ্ছা এবারের ঈদে ছেলের আকিকা আর কুরবানী সেরে ফেলা। আবুলের কাছে কথাটা পাড়েও একদিন।
কিন্তু,আবুলের এক কথা, সামনের ঈদে,
এভাবে দু'দুটো কুরবানির ঈদ চলে গেলেও সালেহার মানতটা অধরাই থেকে যায়।
এরই মধ্যে একবার ছেলে রহিমের কঠিন অসুখ হলো। বৌ সালেহা,রাতদিন অনুযোগ শুরু করলো, তার মানত রক্ষা না করায় আল্লাহর অসুন্তষ্টি পড়েছে তার ছেলের উপর।
কিন্তু; রইসকে সালেহার কান্নাকাটি অনুযোগ কোন কিছুই বিচলিত করতে পারলো না। ওর একই কথা, আমি ফহিমকে কুরবানি দিতে পারবো না, তার আগে সবাই মিলে তাকেই যেন কুরবানী দেয়।
নিরুপায় হয়ে সালেহা পাড়ার হুজুরকে যেয়ে অনুরোধ করলো রইসকে যেন বুঝায়, আল্লাহকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি যেন রইস রক্ষা করে। হুজুর অনেক চেষ্টাও বৃথা গেলে সালেহা তার ছেলে রহিমকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল,তাতেও আবুল তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলো।
ফহিমের দিকে তাকালেই আবুলের মাথায় আকাশ ভেংগে পড়ে, ভাবতেই পারে না, ফহিমকে ছাড়া কেমন করে সে বাঁচবে!
ফহিমও ক্রমেই বুঝতে পারছে তাকে নিয়ে তার মনিবের মনের অশান্তির কথা। গাস বিচালি কোন কিছুই ও তেমন খায় না। আবুলের বুকের কষ্ট গুলো তাকেও সমাচ্ছন্ন করে থাকে।
ক্রমেই ফহিম শুকিয়ে যেতে লাগলো।
পাশের গ্রামের এক পশু চিকিৎসককে এনেও আবুল দেখাল, কিন্তু ফহিমের খাওয়া দাওয়া ক্রমেই কমে যেতে লাগলো।
এদিকে আবারও বছর শেষে কুরবানীর ঈদ চলে এলো। ফহিমের অসুস্থতা আবুলের চোখের ঘুম কেড়ে নিল। শেষ রাতে চোখটা একটু ধরলে ভয়ংকর সব স্বপ্নেরা এসে ভীড় করে, ঘুমাতে পারে না।
এবারের ঈদে ঘরে ঘরে কুরবানির পশু অনেকেই কিনেছে, কিন্তু, অন্যবারের মত আবুল এবার কোন খাশি কিনতেও হাটে গেলো না। প্রতিবেশিরা সবাই ধরে নিল - এবার বোধহয় আবুল তার ফহিমকেই কুরবানি দিবে।
অনেকেই আবুলকে জিজ্ঞেস করলো- এবার তাহলে নিজের ঘরেই কুরবানি হচ্ছে নাকি, আবুল কাউকেই কিছু বললো না। কথাটা আবুলের বৌ এর কানে গেল - তার মানৎ এবার পুরো হচ্ছে, ফহিমকে আবুল কুরবানি দিতে রাজী হয়েছে। সালেহা ছেলেকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। রাতে আবুল আজ প্রথম রাতে স্বপ্ন দেখলো - আকাশ থেকে একদেব দূত এসে তাকে বলছে - আবুল, তোমার বৌকে বলো - আল্লাহ রহমানুর রহিম তার ছেলের আকিকা গ্রহন করেছে। আবুল দু'বার বৌকে নাড়া দিল, সালেহা তখন গভীর ভাবে ঘুমাচ্ছে।
শেষ রাতে আরও একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো আবুল। সে দেখতে পেলো, দু' টো কালো বাঘ এসে তার ফহিমকে গলায় কামড়িয়ে মেরে ফেলচে।
সালেহা পাশে থেকে বল্লো - কি হয়েছে তোমার?
আবুল -দ্রুত ফহিমের ঘরে যেয়ে দেললো, ফহিমের জ্বিব্টা বেরিয়ে আছে,চোখটা নীল হয়ে গিয়েছে। সারাটা নিথর শরীর পড়ে আছে।
ফহিম,ফহিম বলে চিৎকার করে ডাকলো আবুল, ফহিম আজ কোনই সাড়া দিল না।
সকালে প্রতিবেশিরা জড়ো হলো, পাড়ার হুজুর এসে পান চিবুতে চিবুতে বললো- ইডা আল্লাহর ইশারা,কুরবানির নিয়ত খেয়ানতের শাস্তি।
হুজুরের কথা শুনে বিকট এক হাসি দিল আবুল, সে হাসি হুজুরকেও ধাক্কা দিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল - আবুল্ল্যার মাথা ঠিক নাইরে বাপু, সবাই এখন ঘরে যাও। আবুল তখনো হাসছে, হা,হা, করে।