এই রায় কি কাম্য ছিল ?

এই রায় কি কাম্য ছিল  ?

কলমে - শিবব্রত গুহ--

পৃথিবীতে অনেক অনেক দেশ আছে। তাদের মধ্যে, একটি দেশ রয়েছে, যাকে সারা পৃথিবীর মানুষ এক অন্য নজরে দেখে থাকে। সেই দেশের

নাম হল ভারতবর্ষ। এই দেশ হল পৃথিবীর মধ্যে

একমাত্র ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। এই দেশে হিন্দু,

মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ সহ নানা

ধর্মের, নানা বর্ণের মানুষ একসাথে মিলেমিশে থাকে।

এই দেশ চিরকাল বিশ্বের মানুষকে শুনিয়েছে শান্তির বাণী। এদেশ বিশ্বাস করে ত্যাগে, ভোগে নয়। এই দেশের ধর্মনিরেপক্ষ চরিত্র হয়েছিল

কলঙ্কিত। সেই দিনটা ছিল কবে জানেন আপনারা? সে দিনটা হল ১৯৯২ সালের ৬ই

আগস্ট। একদল করসেবক হঠাৎ হামলা চালালো

বাবরি মসজিদে। তাদের দাবি ছিল, ওখানে

ছিল রামমন্দির। এই ঘটনার জন্য ভারতের মান

সন্মান ভুলুন্ঠিত হয়েছিল সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে।

এর খুব খারাপ প্রভাব পড়েছিল সারা ভারতের

ওপরে। এর জন্য, দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল

সাম্প্রদায়িক হিংসা। যা ছিল সত্যিই ভয়ংকর!

এর ভয়ংকরতা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। হাজার হাজার মানুষ এই হিংসার হয়েছিল বলি। কত মানুষ হারিয়েছিল তাদের প্রিয়জনকে, কত মানুষ হারিয়ে ফেলে তাদের শেষ আশ্রয়টুকু, তার হিসাব নেই। এই হিংসায়

জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায় সারা ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।

সেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের রায় বেরোলো

২০২০ সালের গত ৩০ শে সেপ্টেম্বর তারিখে।

১৯৯২ সাল থেকে ২০২০ সাল - সময়টা তো বড়

কম নয়, তবে এই রায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল

সারা দেশের মানুষ।

২৮ বছর পরে, এই রায়কে ঘিরে উৎসাহ উদ্দীপনার ছিল না কোন অভাব। সিবিআইয়ের

বিশেষ আদালতের বিচারপতি, এই মামলায়

অভিযুক্ত ৩২ জনকেই, বেকসুর খালাস করে দেয়।

বিচারপতি এস কে যাদব বলেছেন, " কারোর বিরুদ্ধে প্রমাণ মেলেনি। ষড়যন্ত্র বা পরিকল্পনা হয়েছিল বলেও প্রমাণ মেলেনি। "

অনেক পথ পেরিয়ে, বহু ঘাত - প্রতিঘাতের মধ্যে

দিয়ে গিয়ে শেষে বেরোল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের রায়। এই মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন লালকৃষ্ণ আডবানি। এই রায় শোনার পরে স্বভাবতই খুব খুশি হয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন, " বিশেষ আদালতের এই রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা অত্যন্ত খুশির খবর। অনেকদিন পর এমন খুশির খবর শুনলাম। এই রায়কে

আমি স্বাগত জানাই। রাম জন্মভূমি আন্দোলনের প্রতি আমার এবং বিজেপির বিশ্বাস ও আস্থার জয় হল। "

এই মামলার আর এক অভিযুক্ত মুরলিমনোহর

যোশি। এদিনের রায়ে স্বস্তি পেয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, " এটা আদালতের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। অয্যোধায় ১৯৯২ সালের ৬ ই ডিসেম্বরের ঘটনার পিছনে, যে কোনও

ষড়যন্ত্র ছিল না, এটা তার প্রমাণ। আমাদের কর্মসূচী ও সমাবেশ, কোনও ষড়যন্ত্রের অংশ

ছিল না। আমরা খুশি। এবার, প্রত্যেকরই উচিত,

রাম মন্দিরের নির্মাণে মনোযোগ দেওয়া। "

বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলার রায়দানের দিনে, সশরীরে আদালতে হাজির ছিলেন না, লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলী

মনোহর যোশি, উমা ভারতী, কল্যাণ সিং,

সতীশ প্রধান ও মহন্ত নৃত্যগোপাল দাস। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন ঋষিকেশের হাসপাতালে, ভর্তি রয়েছেন উমা ভারতী।

অতিমারীর মধ্যে, বয়সজনিত কারণে, লালকৃষ্ণ

আডবাণী, মুরলী মনোহর যোশি প্রমুখ

আদালতে আসবেন না, বলে জানান আইনজীবী

কে কে মিশ্র।

ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে, আদালতে তাঁরা হাজিরা দেন। তবে, আদালতে, সশরীরে উপস্থিত ছিলেন, সাধ্বী ঋতম্ভরা,চম্পত রাই, বিনয় কাটিয়ার, বৃজভূষণ শরণ সিং এবং অন্য অভিযুক্তেরা। বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায়,

মোট অভিযুক্তদের মধ্যে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অশোক সিঙ্ঘল, শিবসেনার বাল ঠাকরে, অয্যোধার পরমহংস রামচন্দ্র দাসের মতো

১৬ জন ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন।

কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, " দেরীতে হলেও বিচার প্রক্রিয়ায় সত্যই উঠে আসে।

আডবাণীজি, যোশিজি, উমা ভারতী বেকসুর খালাস পাওয়ায় আমি খুশি।"

এই রায় ঘোষণা হওয়ার পরে, অনেক প্রশ্ন উঠে গেছে। সেগুলো আমি একে একে আপনাদের সামনে তুলে ধরছি ঃ

১. বাবরি মসজিদ তাহলে ভাঙলো কে অথবা কারা?

২. কি তাদের পরিচয়?

৩. ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর কারা কুঠারাঘাত করলো?

৪. তাদের মূল অভিপ্রায় কি ছিল?

৫. তাদের এই ভয়ংকর কার্যকলাপের জন্য,

যাদের প্রবল ক্ষতি হল, সেই ক্ষতি পূরণ হবে কিভাবে?

৬. দেশের সন্মান সারা বিশ্ববাসীর সামনে তারা কেন এভাবে ভুলুন্ঠিত করলো? কেন? কেন করলো?

৭. এভাবে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা

হলো কেন?

৮. এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের চোখের জলের

হিসাব কে দেবে?

৯. তাদের চোখের জল কে মুছিয়ে দেবে?

১০. তাদের হৃদয়ে যে দগদগে ঘা রয়েছে সেই ঘা

কি কখনো শুকাবে?

১১. তাদের এই কাজের মাশুল কে গুনবে?

১২. ভারতের জাতীয় সংহতিকে এভাবে কারা বিপর্যস্ত করে দিল?

- এইসব প্রশ্নের উত্তর আজো রয়েছে অজানা। এসব প্রশ্নের উত্তর জানা খুব প্রয়োজন।

এর উত্তর জানা না গেলে, ভবিষ্যতে আরো বড় আঘাত ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতীয় সংহিতর ওপরে নেমে আসতে পারে। তা কি আমরা চাই? চাই কি? আমি নিশ্চিত জানি,

যে, তা আমরা মোটেই চাই না। সেই ভয়ংকর

দিনগুলির স্মৃতি কি কখনো ভোলা যায়? না,

ভোলা সম্ভব?

ভারতীয় বিচার - ব্যবস্থার প্রতি আমার রয়েছে গভীর আস্থা ও শ্রদ্ধা। তা সত্ত্বেও, আমি একথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে, এই রায় জন্ম দিল অনেক

বিতর্কের। ইতিমধ্যে, এই রায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে দেশের প্রায় সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। তারা এর প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে।

পরিস্থিতি যে কোনদিকে মোড় নেবে? তা এখনই বলা সম্ভব নয়।

লখনউয়ের বিশেষ আদালতের এই রায়ের পরে,

এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সারা দেশ জুড়ে। তা হল, সিবিআই কি এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আর্জি জানাবে? সিবিআই কর্তারা অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তাদের বক্তব্য হল, এ ব্যাপারে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার।

তবে, জাফরিয়াব জিলানি বলেছেন, " তাঁরা এই

রায়ে সন্তুষ্ট নন। তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে অবশ্যই

উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। "

এই রায় যে ভারতের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব

বিস্তার করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এর রেশ যে কতদিন এই দেশের বুকে থাকবে? তা এখনই কিছুতেই বলা সম্ভব নয়।

( তথ্য সংগৃহীত)