কুড়ানো সুখে'র আদ্যোপান্ত
সাদমান সজীব
‘কুড়ানো সুখ’ নামটা শুনলেই মনের মাঝে কেমন যেন একটা ঝঙ্কার বেজে ওঠে, সে ঝঙ্কারের তীব্রতা কতটুকু তা বোঝার জন্যে বইটির সংস্পর্শে যেতে হবে; ছুঁয়ে দেখতে হবে, যেতে হবে বইটির অতল গহিনে । ৮০ পৃষ্ঠায় মোড়ানো বইটি মূলত কবিতার বই, যা ৫৮টি কবিতা দিয়ে সুসজ্জিত। বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোতে চোখ বুলালেই মনে হবে— প্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সুখগুলোই যেন বইটিতে স্থান করে নিয়েছে, আর এ-কাজটি করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন এ সময়ের মনন প্রকৃতির কবি, লেখক- সাংবাদিক মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী।
"দীর্ঘ বেদনার জল অনলে পুড়ে হয়েছি নিঃস্ব
গভীরতার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তবু কেন হতে চাও হিংস্র!
নিদ্রাহীন কেটেছে এই ভাদ্রের বর্ধিত এক রাত
আমার সকল শ্রম, মেধা ও মননে লেগেছে কুঠারাঘাত।"
কবিতাটি ‘কুড়ানো সুখ’ থেকে নেয়া । কবি এখানে নিঃসঙ্গতার গল্প বলেছেন, আমাদের জীবনে এর প্রভাব কেমন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই কবিতায়।
কবি নিজেকে একজন নারীবাদী লেখক হিশেবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছেন, তাইতো তিনি গেয়েছেন নারীদের জয়গান । নিচে নারীবাদী কবিতার একাংশ তুলে ধরা হলো:
"ওহে নারী জাগ্রত হও—
ঘুরে দাঁড়াও প্রবল আত্মবিশ্বাসে
শোনো আমার কথা—
তুমি দুঃখ ভারাক্রান্ত হইও না
হইও না দুঃখ নদীর মত শীর্ণ!
ঘুণেধরা সমাজের জীর্ণতা কাটিয়ে
এগিয়ে চলো সম্মুখপানে
অভিমান ছেড়ে এবার নোঙর তোলো
পৌঁছাতে হবে তোমায় অভীষ্ট লক্ষ্যপানে ।
ওহে নারী, আমায় ঋণ মুক্ত হতে দাও
বলতে দাও তোমার সগৌরবগাথা
তবে শোনো আমার কথা—"
কবি একটি অন্যরকম যুদ্ধের কথা বলেছেন, চলুন তিনি কোন যুদ্ধের কথা বলেছেন তা দেখে নেই:-
"এসো আবার যুদ্ধে যাই, রক্তপাতহীন যুদ্ধে
সমাজ বদলের যুদ্ধে, প্রতিবাদী মৌন যুদ্ধে ।
যুদ্ধ এবার জন্মমাটি, মায়ের ভাষার জন্য নয়
যুদ্ধ হবে—
মানুষরূপী রাঘববোয়াল--হাঙ্গর তিমির বিরুদ্ধে "
আমাদের সমাজে কিছু মুখোশধারী প্রগতিশীল মানুষ আছে, কবি তাদের নিয়েও লিখতে ভুলেননি । নিচে সেই কবিতার কিছু স্তবক তুলে ধরা হলো:-
"আমি এদের মানুষ বলি না!
যারা সুখের স্বপ্নগুলো মুহুর্তেই—
ভেঙে দিতে পারে, দ্বিধা করে না
এরা ভেক ধরে বাঁক বদলের!
সমাজের মুখোশধারী এরা ।
আমি ভয় করি, ওই সব-ঈর্ষাকাতর অসুখী মানুষদের ।
যারা পরশ্রীকাতর, যারা স্বপ্ন দেখায়
আবার অল্পতেই স্বপ্নের বুকে কুঠারাঘাত করে ।
ওরা দেখতে রক্তে মাংসে গড়া মানুষ—
মানুষের দেহ নিয়েই বেড়ে ওঠে ওরা
বাস্তবতায় মনন ও চিন্তায় দানবীয় আচরণ
অসুরের মানসিকতা নিয়ে করে বিচরণ ।
ওদের এতটুকু মানবিক আচরণ নেই—
যা আমি দেখি চতুষ্পদ প্রাণীর মাঝে ।
এরা নাকি সৃষ্টিশীল!
তবে এদের আমি মানুষ বলি না!
যারা ঠকাতে জানে, ঠকতে জানে না
যারা কেবল হারাতে জানে, হারতে জানে না!
যারা কাঁদাতে জানে, কাঁদতে জানে না!"
মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী মূলত একজন প্রকৃতির কবি, আর তাইতো প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় তিনি হারিয়ে যান, কুড়িয়ে আনেন সুখ! তেমন-ই একটি কবিতার কিছু পঙক্তি নিচে তুলে ধরা হলো:-
"আমি শ্রাবণ মেঘ
যাবার বেলায়
বলে যেতে চাই
যা কখনও
হয়নি বলা
আমি এই রোদ এই বৃষ্টি
রোজ প্রভাতে
দেখা হবে
সবুজ ঘাসের
শিশির ক্ণায়
আজ—
বিদায় ক্ষণে
সাদর সম্ভাষণ
শরত তোমায়।"
এছাড়াও এ-বইয়ে মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী বেশ কয়েকজন গুণী ব্যক্তিদের নিয়ে কবিতা লিখেছেন; এদের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী নজরুল ইসলাম, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, সংগ্রামী নারী কাকনবিবি অন্যতম । কবি যতোই এদের জয়গান করেন না কেন, মূলত তিনি প্রকৃতির মাঝেই ডুবে থাকতে চান । কখনো তিনি অন্ধ হয়ে অন্তর্চক্ষু দিয়ে জগতসংসার দেখতে চান, আবার কখনো ডানা মেলে উড়ে বেড়ান হাওর দ্বীপপুঞ্জের শহরে, কখনোবা প্রকৃতির মাঝে কাউকে খুঁজে বেড়ান। তিনি এভাবেই প্রকৃতির মাঝে বিচরণ করতে থাকেন, প্রকৃতির মাঝেই খুঁজে পান তাঁর কবিতার ছন্দ। প্রকৃতিকে অগ্রাধিকার দিলেও কবিতায় তিনি বিভিন্ন বিষয়ের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন, লেখায় এনেছেন বৈচিত্র্য; কখনো শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে অপ্রচলিত শব্দকে প্রাধান্য দিয়েছেন । কবিতায় তিনি কিছুটা ভিন্ন উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন, যা তাঁর কবিতাকে রহস্যময় করে তুলেছে। এই মহাবিশ্বের কোনোকিছুই ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে নয়, তবুও সবাই ছুটে চলে ত্রুটিহীন পথে; মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালীও তার ব্যতিক্রম নন। সবশেষে আমি বলতে চাই— ‘কুড়ানো সুখ’ কাব্যগ্রন্থটি কবির একটি স্নিগ্ধ স্বপ্নের ফসল।