ছোট গল্প: *স্বপ্ন*

ছোট গল্প: *স্বপ্ন*

তাহমিনা বেগম

করিমুন্নেছা মানুষের বাড়ীতে ঝি এর কাজ করে যা পায় তা দিয়ে কোনোরকমে একটা বস্তীতে থাকে।ওর স্বামী আবুল পেশায় একজন নির্মাণ শ্রমিক।ছোট ছোট দুটি সন্তান।দুটিই ছেলে।চলে যাচ্ছে দিন ভালোই।হঠাৎ একটা দূর্ঘটনা ওর জীবন সম্পূর্ণ এলোমেলো করে দেয়।একদিন সবে বাসার কাজ ছেড়ে দুপুরের রান্নার আয়োজন করছিল।আয়োজন বলতে তেমন কিছু না।একবাসার বিবিসাহেব কিছু বাসি ছোটমাছের তরকারী দিয়েছেন।ও কাজ থেকে আসার সময় কিছু শাক কিনে এনেছে।ভাত আর শাক রান্না করার প্রস্তুতি।বেলা অনেক হয়েছে।বাচ্চা দুটো বস্তীর সামনে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলায় মত্ত।চুলায় ভাত ফুটছে ও দ্রুত হাতে শাক বেছে নিচ্ছে।কিছুসময়ের মধ্যে ওর স্বামী দুপুরের খাবার খেতে আসবে।আচমকা কাদের চিৎকার,চেঁচামেচি শুনে দরজায় উঁকি দিয়ে দেখে কারা চিৎকার করছে?ওর স্বামী আবুলকে তিন,চারজন লোক (যারা ওর স্বামীর সাথে কাজ করে )কোলের মধ্যে করে নিয়ে আসছে।আবুলের রক্তাক্ত দেহ দেখে করিমুন্নেসা রান্না ফেলে দৌড়ে বের হয়।আবুল অচেতন।আল্লাগো আমার কি সর্বনাশ হইলো বলে সেও চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু।সাথে সাথে বস্তীর লোকজন জড়ো হয়ে গেল।আবুলের কিভাবে এ অবস্থা হয়েছে জানালো তারা।আবুল সিমেন্টের বস্তা মাথায় নিয়ে বাঁশ ও রশির বাঁধা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যেয়ে পায়ে স্লিপ কেটে ছয়তলার ওপর থেকে নীচে পড়ে গেছে।ভাগ্য ভালো যে সে একেবারে রাস্তায় পড়ার আগেই নীচে থাকা কিছু শ্রমিক ওকে ধরার চেষ্টা করে।তাতে করে রাস্তায় পড়েনি ঠিকই কিন্তু ছিটকে পড়ে মাখানো সিমেন্টের ওপর।এতে জানটা খোয়ায়নি কিন্তু সে মারাত্মক আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে।

বস্তির সবাই মিলে আবুলকে একটি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়।সেখানে পরীক্ষা করে জানা যায় আবুলের ডান পায়ের গোড়ালী ও একটা হাতের হাড় ভেঙে গেছে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পেয়েছে।দীর্ঘ একমাস চিকিৎসা 

শেষে আবুলকে নিয়ে বাসায় ফেরে করিমুন্নেসা।এ ওর কাছ থেকে ধার দেনা করে স্বামীর চিকিৎসা করায়।ডাক্তার বলে দিয়েছেন আবুলের সম্পূর্ণ সুস্থ হতে সময় লাগবে এবং আদৌ আর কাজ করতে পারবে কিনা সেটা পরে বোঝা যাবে।আকাশ ভেঙে

পড়ে করিমুন্নেসার মাথায়।দুদুটো বাচ্চা,ঘরভাড়া,স্বামীর দেখভাল,ঔষধ,বাসাভাড়া।কি করবে দিশা পায় না।ছোটবেলায় বাবা-মা হারা করিমুন্নেছা এক আত্মীয়ের বাড়ীতে অনাদরে,অবহেলায় বড় হবার আগেই নির্মাণ শ্রমিক আবুলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। আবুলেরও কেউ নেই।

করিমুন্নেছা যাদের আশ্রয়ে ছিলো তাদের অবস্থাও স্বচ্ছল নয়।কোনোরকমে দিন পার করতো স্বপ্ল আয়ে।করিমুন্নেছা আবুলের সংসারে এসে ভালোই আছে।কোনোরকমে চলে যাচ্ছিল সুখে দুখে।দেখতে দেখতে পরপর দুটি ছেলে হলো।শুরু হলো অভাব।আবুলের একার আয়ে চলে না।তাই করিমুন্নেসা বাসাবাড়ীতে ঝিয়ের কাজ নেয়।প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হলেও পরে সব মানিয়ে নেয়।এরমধ্যেই নেমে আসে আবুলের এই বিপদ।একা ঝিয়ের কাজ করে আর কয়টাকা পায়।সারাদিন কলুর বলদের মতো খাটাখাটনি।এবাসা ওবাসা থেকে যেটুকু বাসি খাবার দেয় আর বেতনের টাকা দিয়ে কিছুতেই পারছে না চলতে।এরমধ্যে সারা দুনিয়া জুড়ে কভিড -১৯ নামে একটা রোগ আসলো।একে একে সব বাসার কাজ হারালো।সবাই বললো ছোঁয়াচে রোগ এখন তোমাকে কাজে রাখা সম্ভব না।কি কঠিন বিপদ।একে খাবার নেই তার ওপর বস্তীর ভাড়া বাকী পড়তে শুরু করলে বস্তীওয়ালা ভাড়ার তাগিদ দেয়।করিমুন্নেসা এই মহাদূর্যোগ মাথায় নিয়ে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার কাছে হাত পাতে।একবার আড়াইহাজার টাকা ও কিছু চাল,ডাল পেয়েছে।ঐ দিয়ে কোনোরকমে কদিন চলে যায়।এরমধ্যে আবার কাজের সন্ধানে নামে।বাসাবাড়ীতে কাজ খোঁজ করে।আল্লাহ চোখ তুলে চেয়েছেন।তাই দুটি বাসায় আবার কাজ পায়।

কোনোরকমে খাবারের ব্যবস্থা হলেও বাসাভাড়া নিয়ে পড়েছে বিপাকে।আর কদিন মাত্র বাকী

কোরবান ঈদের।যে বাসাদুটোয় কাজ নিয়েছে উনারা বলেছেন কিছু সাহায্য দিবেন।করিমুন্নেছা সুখ স্বপ্নে বিভোর।হয়তো কিছু গোশত ও টাকা পেলে কদিন একটু টেনশন মুক্ত থাকবে।কিন্তু বাসাভাড়া কিভাবে চালিয়ে নেবে? এই কভিড কবে পৃথিবী থেকে নির্মূল হবে? আবুল আবার ভালো হয়ে কাজে ফিরবে? এই স্বপ্নে বিভোর থাকে করিমুন্নেসা।