টিকে থাকার লড়াই

টিকে থাকার লড়াই

রিয়াজ মোহাম্মদ নোমান

সেদিন অবধি অস্ট্রেলিয়ার মতো মস্ত ভূখণ্ডে খরগোশের নাম ও নিশান ছিলো না। গোটা অস্ট্রেলিয়া তন্ন তন্ন করে খুঁজে ও একটা খরগোশ পাওয়া যায়নি। এরপর এসেছে ১৮৫৯ সালে। প্রচন্ড মায়াবী এই চতুষ্পদী প্রাণিটা অস্ট্রেলিয়াবাসির নিকট আশীর্বাদ হয়ে আসেনি। আসেনি দেবদূত হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় মঙ্গল বর্ষাতে। 

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে খরগোশের বিচরণ ইতিহাস কাঁপানো এক দৈন্য দুর্দশার গল্প। চীন যেমন তার দুঃখ ''হুয়াং হো'' নদীকে কাঁধে বইয়ে চলছে তেমনি অস্ট্রলিয়া ও তার দেশের খরগোশকে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাঁধে বইয়ে চলছে। এই ছোট্ট মায়াবী প্রানিটির কারণে অস্ট্রেলিয়া সরকারের প্রতিবছর বিলিওন বিলিওন ডলার ক্ষতিপূরণ গুণতে হয়। 

সে ঘটনাটা বলছি। 

এ ঘটনার শুরুটা হয় ১৮৫৯ সালে। থমাস অস্ট্রিন নামক ইংল্যান্ড বংশভুত এক অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকের হাত ধরে। থমাস অস্ট্রিন একজন ভোগ বিলাসী ও শিকার প্রিয় মানুষ। ইংল্যান্ডের বন বাদুরে ঘুরে ঘুরে শিকার করতেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসনের পর শিকারে মন পাচ্ছিলেন না। আসলে মন, সুযোগ কোনোটাই পাচ্ছিলেন না তিনি। শিকারি মন শিকারের নেশায় উদ্মাদ হতে থাকলো। শিকারের নেশা থামাতে থমাস অস্ট্রিন ইংল্যান্ডে বসবাসরত তার ভাগ্নে কে জাহাজে করে খরগোশ পাঠানোর জন্য চিঠি পাঠালেন। 

অতঃপর সময়যজ্ঞে অস্ট্রিনের নিকট নিকট চব্বিশ জোড়া খরগোশ এসে হাজির হয়। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এই প্রথম খরগোশের পা পরলো। অস্ট্রিন তার বাড়ির উঠোনে খরগোশ ছেড়ে মনের আনন্দে নাচতে লাগলেন। বাড়ির উঠোনে খরগোশ পুষে ছেড়ে দেবেন জঙ্গলে তারপর সে খরগোশ নিজেই শিকার করে খাবেন, এইটুকু স্বপ্ন তার। 

তারপর আসলো ১৮৫৯ সালের অক্টোবর মাস ; থমাস অস্ট্রিন উঠোনের খাঁচা খুলে সমস্ত খরগোশকে উন্মুক্ত করে দিলেন। এই ভুলের মাশুল যে এভাবে দিতে হবে তা জানলে হয়তো এ ভুল তিনি কখনোই করতেন না। এই খরগোশের দলকে আর থামানো যায়নি। চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ, আটচল্লিশ থেকে বাহাত্তর এভাবেই চলতে চলতে দশবছরে পৌঁছে গেলো ত্রিশ থেকে চল্লিশ লক্ষে।

অস্ট্রেলিয়া সরকার সে ঘটনার দশ বছর পর অর্থাৎ ১৮৬৯ সালে গুলি করে বিশ লক্ষ খরগোশ হত্যা করে। করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এতেও তাদের বংশ বিস্তার ঠেকানো গেলো না। না ঠেকানো গেলো প্রজনন, না ঠেকানো গেলো ক্ষয় ক্ষতি। ১৯৫০ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকার 'মাইক্সোমা ভাইরাস' প্রবিষ্ট করে খরগোশ প্রজাতিতে মহামারি তৈরি করা হলো। কৃত্তিম ভাবে 'খরগোশ প্লেগ' ছড়িয়ে দেয়া হলো। ১৯৯৬ সালে 'ক্যালসি ভাইরাস' ছড়িয়ে দেয়া হলো। কোনো ফায়দা হলো না। দিন দিন এদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। ভূমির অবক্ষয়, জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট, ফসলের ক্ষয় ক্ষতি এতসব সামাল দিতে দিতে অস্ট্রেলিয়ান সরকার দিশেহারা। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের আট ভাগের এক ভাগ স্তন্যপায়ী প্রজাতি এই খরগোশদের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত ও হয়েছে। 

এতক্ষণ যা বলেছি তা কোনো কাল্পনিক বানোয়াট গল্প নয়। অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া জলবায়ু বদলে দেয়া সত্যি ঘটনা যা ইতিহাসে ঘটেছে বর্তমানেও ঘটছে। 

এই ইতিহাস থেকে আমরা যা শিখলাম; ''অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মাঝে মাঝে অমানবিক কাজকে শুদ্ধ করে নিতে হয়।''

ইতিহাসটা ব্যখ্যা করার প্রয়োজন মনে করেছি একটা অতিব জরুরি কারণে। ঢাকার কুকুর নিধন কর্মসূচির কারণে। 

গত ২ সেপ্টেম্বর নগর ভবনের সামনে কুকুর নিধন পক্ষের মানববন্ধন ও মেয়র বরাবর স্মারক লিপির ফলাফল হিসেবে ডিএনসিসি ঢাকা শহরের ৩০ হাজার কুকুর নিধনের সিদ্ধান্ত নেয়। 

ডিএনসিসির ৩০ হাজার কুকুর নিধন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আবার ২৯ আগস্ট কর্মসূচি পালন করে কতিপয় পশুপ্রেমি সমাজ সংগঠন।

একদল মানববন্ধন করছে কুকুরের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে আরেকদল মানববন্ধন করছে কুকুরের জীবন বাঁচাতে। কেউ কারো যায়গায় ভ্রান্ত বা পথভ্রষ্ট নয়। সবাই সবার যায়গায় সঠিক। দুদলের যুক্তি ই গ্রহণযোগ্য। একদল অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে চান আরেকদল ৩০ হাজার কুকুরের জীবন বাঁচাতে চান।    

  

দুই কোটির বেশি জনবহুল সমৃদ্ধ ঢাকা শহরে প্রায় ৩৭ হাজার কুকুরের আবাসস্থল। ইট পাথর, গাছ পালা আর শহরের মানুষের মতো এরাও এ শহরের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে গেছে। এদের প্রতি শহুরে মানুষগুলো ও বেশ সহানুভূতিশীল ওদিকে কুকুরের তো প্রভুভক্ত প্রাণি হিসেবে খ্যাতি আছে'ই। সব মিলিয়ে এ শহরের মানুষের সাথে কুকুরের যেমন ঘটেছে আত্মার মিলন তেমনি এ শহরটার ইট বালি ধূলিকণার সাথেও কুকুরগুলোর ঘটেছে ভালোবাসার মিলন। কুকুরের প্রতি ভালোবাসার যেমন রয়েছে অজস্র কারণ তেমনি কুকুর নিধন বা দমন করার পেছনেও রয়েছে অজস্র কারণ। লোকজনকে কামড়াচ্ছে, খাবার ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, রাত ভর ডেকে ডেকে মানুষজনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, অন্যান্য পশু পাখির বাচ্চা খেয়ে ফেলছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি যেকোনো ধরণের প্রাণ হত্যার পরিপন্থী কিন্তু 'ন্যাচারাল ল' বা প্রাকৃতিক আইন বলে একটা কথা আছে। প্রকৃতিতে সকল প্রাণিকেই সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। বেঁচে থাকতে হলে এক প্রজাতি অন্য প্রজাতিকে হত্যা করেই টিকে থাকতে হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। 

থমাস অস্ট্রিনের ছোট্ট ভুলের মাশুল যেমন আজো অস্ট্রেলিয়াকে দিতে হচ্ছে, না জানি আমার কোনো ভুলের মাশুল আমার দেশকে আর দেশের মানুষকে এরকম ভাবে দিতে হয় তাই ভেবে আমি শংকিত। আমি অবশ্যই মানববাদি পশুপ্রেমি মানুষ। আমি জগতের প্রতিটি প্রাণিকেই ভালোবাসি। তবে যেহেতু আমি একজন হোমো স্যাপিয়েন্স তাই সকল প্রজাতির উপরে আমি আমার প্রজাতিকে ই প্রাধান্য দেবো। আমি চাই কুকুরগুলো প্রকৃতির আলোয় উদ্যমে ঘুরে বেড়াক তবে তা প্রকৃতির নিয়মে আর প্রকৃতির শৃঙ্খলে।