নাজু -নজিমুল্লা (ছোট গল্প)

নাজু -নজিমুল্লা (ছোট গল্প)

তাহের মাহমুদ ---

ভাদ্রের ভর দুপুরে ভ্যাপসা গরমে গাঁও-গেরামে গাছের একটুখানি ছায়া বড় বেশি মায়া দেয়। গতরের ভিতরে-বাইরে শান্তি লাগে। নাজু'র বাবা সেই বেইন্যাকালে ক্ষেতে মজুর যায়। ভাতের বাসন আর পানির মগ লইয়া বাপের দুপুরের আহার মিটাইতে যায় নাজু। মাঝপথে গাছের গোড়ায় জিরানী দেয়। 

মা-মরা সেয়ানা মাইয়া। একমাত্র মাইয়া। নাজমা। আদর কইয়া মাইয়াডারে ওর মা'য় নাজু কইয়া ডাকতো। সেই থেইকা নাজু। বাড়ির আশেপাশে সমবয়সী মাইয়ারা কেউই আর বাবার বাড়ি নাাই। বিয়া হইছে সবগুলারই। কারো কারো পোলাপানও ইসকুল করে। 

বাড়ির চাচীরা, ভাইয়ের বউরা নাজুর বাপ নজিমুল্লারে মাইয়ার বিয়ার কথা কইয়া প্রায়ই খিস্তিখেউড় করে। নজিমুল্লা এতোদিন খালি শুনছে। আমলে নেয় নাই। মাইয়াডা পরের বাড়ি গেলে নজি'র কপাল থেইক্কা ক্ষেতে বইয়া দুইনলা ভাতের যে মরন অইবো হেইডা যেমন ভাবে তেমনি মাইয়ার জীবনডার কথাও ভাবে। এইবার শক্ত কইরা মনটারে বান্ধে নজিমুল্লা। 

বউয়ের কঠিন রোগে বসতভিটা গেছে বছর চারি আগেই। নজিমুল্লার বড় চাচা- থাকার জায়গা দেওনের শর্তে বাড়ি লেইখ্যা নিয়া টেকা দেয় নাজুর মার চিকিৎসা করতে। একচালা ভাঙাচোরা একটা ঘর আর একটা গাইগরু। পালের শেষ সম্বল দুধের গাইডা বেইচ্চা দিয়া গেরামের মেম্বর ছলিম বকসের কাছ থেইকা আরো বারো হাজার কর্জ নেয়। শোধ দিতে না পারলে একচালা ঘরটা বেইচা পরিশোধের কসম দেয় নজি। সত্তর হাজার যৌতুক দিয়া নাজুরে বিয়া দেয়। লগের গেরামের ছামান ঢালির ছোট পোলাডা দেখতে হুনতে খারাপ না। বাঁশ-বেড়ার ছৈয়ালী কাম করে। গায়ে-গতরে ভালা। 

আইজ এক হপ্তা নজিমুল্লার একলা কাটে। কামে যায়না। চোখ দুইটা গোয়াল ঘরের শূণ্য আতালের দিকে ফ্যাল ফ্যাল কইরা চাইয়া থাকে। নিজে রান্দে নিজে খায়। দুইদিন রান্ধন নাই, জ্বরজারিতে কাবু হইয়া অহন আর দাওয়ায় বহোনেরও শক্তি নাই। 

নাজুর মনডা পইরা রইছে একলা বাপের বিরান উঠানে। মানুষটা কি করে, কেমনে রান্দে, কেমনে খায়। রাইত পোহাইলে ঈদের দিন। নতুন সংসারে বহুত কাম কাইজ। কিন্তু নাজুরতো আর একদমই ভাল্লাগতাসে না স্বামীর বাড়ি। কাকডাকা আন্ধারে নতুন সংসারের বাসি ঘরদোর বাসনকোসন ফালাইয়া বলা নাই কওয়া নাই বাড়ির পেছনের আইল ধইরা দৌড়াইতে থাকে। এমন দৌড় বহুদিন দেয়নি নাজু। দৌড়ায় আর মনের মইধ্যে বাপের মুখটার দিকে চায়, দৌড়ায় আর বাপের মুখটা দেখে। মনে হইতে থাকে মায়ের মরোনের কালের সেই মুখটাও। দৌড়ায় আর ভাবতে থাকে বাপেরে শেষ কবে জড়াইয়া ধরছে মনে করতে পারেনা। আইজ বাপের বুকটার মইধ্যে জোকের লাহান মিশশা থাকবো নাজু। 

বাবা অ বাবা, বাবা তুমি কই? নাজুর গলা শুকাইয়া যায়। বাপের সাড়া মিলেনা। না, নজিমুল্লা সাড়া দেয়না। নাজুর চিৎকারে একে একে বাড়ির পাষানী চোখগুলা ভিড় করে ভাঙা ঘরের দরজায়। 
একটা বড় পাথ্থরের লাহান দেহ বুকটার মইধ্যে জড়াইয়া থাকে নাজু, কিন্তু সেই বুক আর নাজুরে জড়ায়না।