-পাত সঞ্চালন তত্ত্বের খুঁটিনাটি-

-পাত সঞ্চালন তত্ত্বের খুঁটিনাটি-


লেখক- রিয়াজ মোহাম্মদ নোমান

---পাত সঞ্চালন-
বিজ্ঞানের জগতে নব্য আধুনিক এবং টাটকা তত্ত্বের মধ্যে একটি হলো পাত সঞ্চারণ তত্ত্ব। আসলে এই তত্ত্বকে এখন আর তত্ত্ব বলা যাবে না। এখন একে বলা হয় বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্ট। মানে চিরচারিত ঘটনা। এ তত্ত্ব পৃথিবীর ভূত্বক কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর ভূত্বককে বলা হয় অশ্মমণ্ডল। এই অশ্মমণ্ডলের প্লেটগুলোর চলাচলকে বলা হয় প্লেট টেকটনিক তত্ত্ব।
এই তত্ত্বের শুরুটা হয় ১৯১২ সালে আলফ্রেড ভেগেনারের মহিসঞ্চারন তত্ত্বের মধ্য দিয়ে। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট শহরে একটি জনসভায় ভেগেনার সর্বপ্রথম তার এই তত্ত্বের জানান দেন।
পরবর্তীতে তার ‘‘Die Entstehung Der Kontenente & azeane’’ বইতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। ভেগেনারের তত্ত্ব মতে-

‘‘এই পৃথিবীর ভূত্বক গুলো ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। যা প্রতিনিয়ত তার যায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। একে অপরের থেকে সরে যাচ্ছে আবার মিলিত ও হচ্ছে।’’

বলে রাখা ভালো এ দাবী তিনি সর্বপ্রথম উত্থাপন করেননি তারও আগে ফ্রেন্সিস বেকন, মার্কিন বিজ্ঞানী উইলসন সহ অনেকে এরকম ই একটি মত প্রদান করে। সর্বশেষ ১৯৬৮ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী পিচন পাত সঞ্চলন তত্ত্ব সুস্পষ্ট ব্যখ্যা দিয়ে পাত সঞ্চালন তত্ত্বকে ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

গোলাকার এই পৃথিবীর মোট আয়তনের ৭১ ভাগ জল আর মাত্র ২৯ ভাগ স্থল। এই স্থলভাগটুকু পৃথিবী জন্মের শুরু হতে আজ অবধি একস্থানে আটকে নেই। এদের মধ্যে ফাটল ধরেছে এরা বিচ্ছিন্ন হয়েছে এরা আবার একত্রিত হয়েছে এরা যায়গা পরিবর্তন করেছে। এভাবেই এরা চলছে অবিরাম। পৃথিবীর ভূখণ্ডের এই চলাচল বা সঞ্চালনকে বলা হয় পাত সঞ্চালন তত্ত্ব।
সঞ্চালন তো বুঝলেন এবার আসি পাতের ব্যাপারে। পাত হলো প্লেট। পাতকে প্লেটের মতো করে ধরি। যে প্লেটের উপর দাঁড়িয়ে আছি আমরা। আমাদের পায়ের নিচের এই প্লেট গুলো ক্রমশ স্থ্যানচ্যুত হচ্ছে। এই পাতগুলো বছরে ঠিক কতো সেন্টিমিটার করে সরে যাচ্ছে সরে গিয়ে কোথায় যাচ্ছে ভবিষ্যতে কোথায় যাবে তা নিয়ে সুসঙ্ঘত ব্যখ্যা ই হল প্লেট টেকটোনিক তত্ত্ব। পাত সঞ্চালন বা প্লেট টেকটোনিক দুটোই কিন্তু এক এর আরেকটি নাম হলো কন্টিনেন্টাল ড্রিফট।

পাতের সংখ্যা-
বিজ্ঞান গবেষণা অনুযায়ী এই পৃথিবীতে ৬ টি বড় পাত, ৮ টি মাঝারি ও ২০ টি ছোট পাত রয়েছে।

পাতের আয়তন-
বড় পাতের আয়তন ১-১০০ কোটি বর্গ কিলোমিটার।
মাঝারি পাতের আয়তন ১০ লক্ষ থেকে ১ কোটি বর্গ কিলোমিটার।
ছোট পাতের আয়তন ১ থেকে ১০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার।

পাতের অবস্থান-
প্রধান পাত সমূহ -
১/ প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাত।
২/ ইউরেশীয় পাত।
৩/ ইন্দো অস্ট্রেলীয় পাত।
৪/ আফ্রিকা পাত।
৫/ এন্টারটিকা পাত।
৬/ আমেরিকা পাত।

অপ্রধান পাত সমূহ-
১/ আরব পাত।
২/ ক্যারেবীয় পাত।
৩/ হুয়ান দে ফুঁকা পাত।
৪/ কোকাস পাত।
৫/ নাজকা পাত।
৬/ ফিলিপিনীয় পাত।
৭/ স্কোশিয়া পাত।
(সমস্ত পাত সম্পর্কে লেখা হয়নি)
আমাদের অবস্থান ইন্দো অস্ট্রেলীয় পাতের মধ্যে। আমাদের পাতের নাম ভারতীয় পাত। এ সম্পর্কে খানিকবাদে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

পাত পরিবর্তনের কারণ-
এই পৃথিবী স্তরে স্তরে সাজানো। এই স্তরগুলোকে এখানে আমরা ৫ টি ভাগে ভাগ করবো অর্থাৎ পেঁয়াজের মতো করে পৃথিবীর ও খোলাসা করবো এখন ।
* মহাদেশীয় ত্বক
* উপস্থ ভূ আচ্ছাদন
* নিম্নস্থ ভূ আচ্ছাদন
* বহিঃস্থ মজ্জা
* অন্তঃস্থ মজ্জা।

এবার নিচ থেকে শুরু করি; অন্তঃস্থ মজ্জা থেকে আরম্ভ করি। অন্তঃস্থ মজ্জা হলো আদি পৃথিবী। অর্থাৎ ৪৫৪ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবী যেমন অগ্নিপিণ্ড হিসেবে ছিলো এই অন্তঃস্থ মজ্জা ও একরকমের অগ্নিপিণ্ড। এর তাপমাত্রা ৫৭০০ কেলভিন যা প্রায় সূর্যের বাইরের তাপমাত্রার সমান। এখানে জমা আছে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের বিকিরন ও সৃষ্টি লগ্নের পৃথিবীর আটকে পড়া তাপশক্তি। এ তাপশক্তি পৃথিবীর অভ্যন্তরে চক্রাকার ফুটন্ত লাভার সৃষ্টি করে। এ চক্রাকার ফুটন্ত লাভা মাঝে মাঝে উপরের দিকে ঠ্যালা মারে যার ফলে প্লেটগুলো চলতে শুরু করে। এই ঠ্যালা মারার ফলে আরো দারুণ কিছু কার্যসাধন হয়। যেমন- এই ঠ্যালার ফলে চর চর করে অগ্নেয়গিরি থেকে লাভা বের হতে শুরু করে যার কারণে পৃথিবীর ভেতরটা স্থিতিশীল থাকে। এ লাভা যদি বের হওয়ার সুযোগ না পেত তাহলে দেখা যেত পৃথিবী এতোদিনে উত্তাপে ফেটে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে মহাকাশে টুকরো টুকরো আকারে ভেসে বেড়াচ্ছে।

অন্তঃস্থ মজ্জার ঠিক উপরের স্তরেই আছে বহিঃস্থ মজ্জার অবস্থান। এটি আদি পৃথিবীর উপর প্রথম পাথুরে স্তর।
তারউপরে রয়েছে নিম্নস্থ ভূ আচ্ছাদন তারউপরে রয়েছে উপরস্থ ভূ আচ্ছাদন এবং সবশেষে রয়েছে পৃথিবীর উপরিভাগ যাকে বলা হয় মহাদেশীয় ত্বক।

মহাদেশীয় ত্বকের অবস্থান-
এবার আমরা অতীতে চলে যাই। ৫৫ কোটি বছর আগেরকার পৃথিবীতে চলে যাই। ৫৫ কোটি বছর পূর্বে এই পৃথিবীতে দুটি মহাদেশ ছিলো। অর্থাৎ পুরো বিশ্বের সমস্ত মাটি মাত্র দুটি ভাগে পৃথক ছিলো। এর মধ্যে একটি বেশ বড় সড় অপরটি বেশ ছোট খাটো। বড় মহাদেশটির নাম ছিলো ‘‘গন্ডোয়ানা মহাদেশ’’। আর অপরটির নাম ছিলো ‘‘ইউরেশীয় মহাদেশ’’। এ দুটি ছাড়া গোটা পৃথিবীতে আর অন্য কোনো ভূখণ্ড ছিল না।

এবার আমরা আরেকটু সামনের দিকে আসি। ৩৫ কোটি বছর আগেরকার পৃথিবীতে। সেই ছোট ইউরেশীয় মহাদেশটি গন্ডোয়ানায় এসে একত্রিত হয়েছে। কি বিস্ময়কর ব্যাপার ! গোটা পৃথিবীতে একটা ই ভূখণ্ড। বিজ্ঞানীরা সে ভূখণ্ডের নাম দিয়েছেন ‘‘প্যানজিয়া’’ । প্যানজিয়া হলো তখন অতি অতি মহাদেশ।
প্লেট টেকটনিক্সের কারণে ইউরেশীয় পাতটি গন্ডোয়ানায় এসে মিলিত হয়ে তৈরি করে প্যানজিয়া নামক অতি অতি মহাদেশের। আবার প্লেট টেকটনিক্সের কারণে এই প্যানজিয়া নামক অতি অতি মহাদেশ আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করে। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ আলাদা হতে থাকে।

এবার আরেকটু সামনের দিকে আসি। ১৮ কোটি বছর পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশীয় প্লেট গন্ডোয়ানা থেকে ভেঙ্গে উত্তর দিকে চলতে শুরু করে। এখানে বলা বাহুল্য ততোদিনে ইউরেশীয় প্লেট গন্ডোয়ানা থেকে আলাদা হয়ে দূরে চলে গেছে। ভারতীয় প্লেট চলতে শুরু করলো অতি দ্রুত। মনে হচ্ছে তার বিশাল তাড়া। ছুঁতে হবে ইউরেশীয় পাতে। অতি দ্রুত ছুটতে ছুটতে মাত্র ৫ কোটি বছর পূর্বে গন্ডোয়ানা থেকে পৃথক হওয়া ভারতীয় পাত স্পর্শ করে ইউরেশীয় পাতের সীমানা। এখানে একটা জিনিস লক্ষ্য করুণ ভারতীয় পাত মাত্র ৭ কোটি বছরে ছুটে এসেছে ৯ হাজার কিলোমিটার। খুব অদ্ভুত হলেও সত্য ভারতীয় পাতের এই এক দৈব শক্তি এতো অল্প সময়ে কি করে পাড়ি দিলো এতোখানি পথ? তার কারণ হলো অনান্য সাধারণ পাত বছরে ছুটে চলে ৫ সেন্টিমিটার করে কিন্তু ভারতীয় পাত ছুটেছে বছরে ২০ সেন্টিমিটার করে। অর্থাৎ চার গুণ দ্রুত। এই দ্রুত ছুটে চলার ফলাফলটা ও হয়েছে রোমাঞ্চকর। স্বভাবত ই যে কোনো গতিশীল বস্তু যত দ্রুত বেগে অন্য কোনো বস্তুকে ধাক্কা মারবে তার ফল ততোটা ই বিকট হবে আর সেই ফলাফল নির্ভর করবে গতিশীল বস্তুর গতির উপর। এক্ষেত্রেও এমনটা ই হয়েছে। দ্রুত গতিতে ছুটে আসা ভারতীয় পাত এতোই জোরে সংঘর্ষ বাঁধায় যার ফলে ১৫০০ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে মুহূর্তে চর চর করে দাঁড়িয়ে যায় হিমালয় পর্বতমালা। গোটা পৃথিবীর চিত্র পাল্টে দেয়া হিমালয় পর্বতমালার জন্ম এখান থেকেই আর হ্যাঁ এখান থেকেই বিবর্তন ঘটে তিমির । স্তন্যপায়ী প্রাণী তিমি ভারতীয় পাত থেকেই জলে নেমে যায়।

ইতিকথা-
আফ্রিকা থেকে আগত হোমো ফ্লোরিয়েন্সিসদের একদল ইন্দোয়নেশিয়ার ফ্লোরো দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। বেচারারা হাঁটতে হাঁটতে চলতে চলতে এই দ্বীপে আসার পর প্লেট টেকটনিক্সের কবলে পড়ে। ফ্লোরো দ্বীপ গহীন জলরাশির দিকে চলতে শুরু করে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা যখন কম ছিলো বেচারারা হেঁটে হেঁটে সেখানে গিয়ে বাসা বাঁধেছিলো কিন্তু কপাল দোষে আর পরিবেশের বিবর্তনের ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যায়। বেচারারা ও সেখানে আটকে পড়ে যায়। মরার উপর খারার ঘা।
ওদিকে ফ্লোরো দ্বীপে প্রয়োজনীয় রসদ না থাকায় হোমো ফ্লোরিয়েন্সিসরা মারা পড়তে শুরু করে এবং সর্বশেষ ১২,০০০ বছর পূর্বে এক অগ্নুতপ্লাতের ফলে এরা পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্তির পথে হাঁটা ধরে ।