মোখার ক্ষয় সেন্টমার্টিনে সবচেয়ে বেশি

বাংলাভাষী ডেস্কঃঃ

আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী যে শঙ্কা ছিল অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে সেই তুলনায় বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূলে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তুলনামূলক কম। তবে মোখার আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ও টেকনাফের কয়েকটি এলাকা।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ি কক্সবাজার জেলায় ২ হাজার ৫২২টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। শুধু এই দ্বীপেই বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ১২০০ ঘরবাড়ি।

এতে বলা হয়, কক্সবাজারে মোট ৫৭টি ইউনিয়ন ও ৩টি পৌরসভা ঘূর্ণিঝড় মোখায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে ১০ হাজার ৪৬৯টি বাড়িঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্গত মানুষের সংখ্যা ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬২০।

সেন্ট মার্টিন ও টেকনাফ উপকূলের কয়েকটি এলাকায় ঘরবাড়ির পাশাপাশি গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উপড়ে গেছে। ঘরবাড়ি, গাছপালার ক্ষতি করে মোখা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করেছে।

রবিবার (১৪ মে) বিকাল ৩টার দিকে সেন্টমার্টিন উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মোখা। কক্সবাজার জেলা আবহাওয়া অফিসের প্রধান আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান জানান, ‌‘বিকাল ৩টার দিকে সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়টি। এতে ওসব এলাকার ঘরবাড়ি, গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ভেঙে গেছে।’

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান জানান, ‘সাবরাং ইউনিয়ন, সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপের ঘরবাড়ি ও স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোথাও কোথাও গাছপালা ও কাঁচা বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। তবে জলোচ্ছ্বাস হয়নি।’

তিনি বলেন, মূলত সকাল ৯টা থেকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব শুরু হয়। বিকাল ৩টার দিকে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে গতিপথ বদলে মিয়ানমারের দিকে চলে যায় ঘূর্ণিঝড়টি। সন্ধ্যা ৬টার দিকে প্রভাব কমে এটি পুরোপুরি দুর্বল হয়ে যায়।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের প্রধান বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, ‘বেলা ২টা থেকে ঝোড়ো বাতাস শুরু হয়েছিল। বিকাল ৩টার দিকে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়। আশ্রয়কেন্দ্রের লোকজন নিরাপদে আছেন। হতাহতের কোনো খবর পাইনি।’

জেলা আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, সেন্টমার্টিন ও টেকনাফের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়টির বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৫০-৫৫ কিলোমিটার। যা ক্ষতি হয়েছে, এর চেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নেই।

স্থানীয়রা জানান, রবিবার সকাল থেকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়তে শুরু করে। দুপুরের দিকে বৃষ্টি ও বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। বিকাল ৪টার পর তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

টানা এক ঘণ্টার বেশি প্রচণ্ড বাতাস ও বৃষ্টির পর আবহাওয়া ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকে। বিকাল ৫টার পর বেরিয়ে দেখা যায়, রাস্তাঘাটে গাছপালা উপড়ে পড়েছে, বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে টিনের ও কাঁচা ঘরবাড়ি।

রবিবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, সেন্ট মার্টিনে ১২০০ মতো ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। তবে জেলাজুড়ে হতাহতের কোনো খবর আমাদের কাছে নেই।’

এ সময় তিনি আরও জানান, আবহাওয়া একটু ভালো হলেই জেলা প্রশাসনের ত্রাণ তৎপরতা ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ শুরু হবে।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা স্থানীয় মেম্বার ও লোকজনের কাছ থেকে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য নিচ্ছি। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গাছপালা উপড়ে গেছে, ঘরবাড়ি ভেঙে মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।’

তবে এখনি প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি জানা সম্ভব না উল্লেখ করে ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। আকাশ বেশ মেঘাচ্ছন্ন, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, সেন্ট মার্টিনের মূল ভূখণ্ডের কোথাও জলোচ্ছ্বাস হয়নি।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে দুই হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঝড় কমে যাওয়ার পর অনেকেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।

পুরুষরা আগে বেরিয়ে কাছাকাছি থাকা বাড়িঘর গিয়ে দেখে আসে। পরে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে সঙ্গে থাকা জিনিসপত্রসহ নারী ও শিশুদের নিয়ে বাড়িঘরে যায়। তবে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন তারাই; যাদের বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।

সড়কে গাছপালা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও গাছ উপড়ে বাড়িঘরে পড়েছে। বাড়ির সীমানা প্রাচীর পড়ে গেছে। এর মধ্যেই লোকজন বাড়ি ফিরছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ান সাংবাদিকদের জানান, ঘরবাড়ির পাশাপাশি মাঠে থাকা গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি ও গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগেভাগে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ায় লবণের মাঠে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।

ঘূর্ণিঝড়ের আগেই লবণ সংগ্রহ করা হয়েছে। যেসব লবণ সংগ্রহ করা যায়নি সেখানে মাটিতে গর্ত করে প্লাস্টিকের শিটে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। শুটকি উৎপাদনকারীদেরও কোনো ক্ষতি হয়নি। মাইকিং করে সব শুটকি আগেই দ্বীপগুলো থেকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ে হতাহতের সংখ্যার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হতাহতের ঘটনা নেই বললেই চলে। সব মিলিয়ে ১৫-২০ জনের মতো হবে। তারা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সেন্ট মার্টিনের বাইরে টেকনাফ ও উখিয়ায় বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। টেকনাফে প্রায় ৫০০ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। মহেশখালীসহ অন্যান্য উপজেলাগুলোতে ৫০-৬০টি করে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কুতুবদিয়ায় ঝড়ের গতিবেগ কম থাকায় ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়েছে।