মৃত্যু হচ্ছে জীবনের পরিসমাপ্তি

মৃত্যু হচ্ছে জীবনের পরিসমাপ্তি

 লিটন দাশ গুপ্ত। 

‘আঁধার ঘরত রাইত হাডাইওম হারে লোই বন্ধু গেইলেগোই, হাল্যা ঘরত রাইত হাডাইওম হারে লোই।’ 

এখানে আঁধার ঘর মানে চিতা বা কবর, আর বন্ধু মানে দেহ ও প্রাণের পারস্পরিক বন্ধুত্ব। অর্থাৎ প্রাণ চলে গেলে দেহ কিভাবে চিতাতে বা কবরে অন্ধকারে একা থাকবে সেটাই বুঝানো হয়েছে। 

উপমহাদেশের বরেণ্য ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবিয়াল রমেশ শীল রচিত মৃত্যু সম্পর্কিত আধ্যাত্বিক এই গানটি ছোট বেলা থেকে শুনে আসছিলাম। শৈশব থেকে শুনে এলেও সময়ের ব্যবধানে এই সময়ে শোনার অনুভুতি অন্যরকম। এইটুকু জীবনের হিসাব নিকাশ করতে গিয়ে ভাবতে থাকি, মানুষের জীবন কত যে সংক্ষিপ্ত! দেশে মানুষের গড়আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে একাত্তরে উন্নীত হয়েছে। তাতে সৃষ্টির সেরা জীব মানবজাতির কিইবা হয়েছে; যেখানে একটি সামুদ্রিক কচ্ছপ বাঁচতে পারে ১৮০০ বছর পর্যন্ত যাদের গড়আয়ু ৫০০ বছর, কিংবা সমুদ্রের শামুক ঝিনুকের গড়আয়ু ২৫০ বছরের বেশী!

জীবনের বয়স হিসাব নিকাশ করতে গিয়ে কল্পনাতে অনুভব করতে থাকি, জন্মের পর থেকে প্রথম ১০ বছর সময়টাকে মনে হয়েছিল ১০০০ দিনে ১ বছর। এরপর ১১ বছর থেকে ২০ পর্যন্ত সময়টা মনে হয়েছে ৫০০ দিনে বছর ছিল। পরবর্তী ২১ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত ৩৬৫ দিনে বছর অনুভব করতে পেরেছিলাম। এরপর ৩১ বছর থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত মনে হয়েছিল ২০০ দিনে এক বছর। এখন ৪১ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত সময়টাকে ১০০ দিনে বছর মনে হচ্ছে। অর্থাৎ বয়স যত বাড়তে থাকে, বছরের দিন সংখ্যাও ততই কমতে থাকে মনে হচ্ছে। যদিও সৃষ্টির আপন নিয়মে সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী একইভাবে প্রদক্ষিণ করে চলেছে; অর্থাৎ বার্ষিকগতির সময়সীমা অপরিবর্তিত রয়েছে। তারপরেও কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনাগুলো মনে হয়, এই যেন কয়দিন আগের কথা! এইভাবে জন্ম-মৃত্যু আর জীবন নিয়ে ভাবতে গিয়ে মাঝে মধ্যে চিন্তায় পড়ে যায়, মানুষ কোথা হতে আসে আবার কোথায় চলে যায়! আসা যাবার এই নিয়মে মনে হয় আমরা কোথাও যেন বেড়াতে বা ভ্রমণে এসেছি। এখন বেড়ানোর জন্যে নির্ধারিত সময় শেষ হলে আবার বাড়ি ফিরতে হবে। তাই এই বয়সে এসে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, ভ্রমণের নির্দ্দিষ্ট সময়টুকুর প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছি। এখন নিজ বাড়িতে যাবার প্রস্তুতি নেবার সময় এসে গেছে। যা আগে কখনো এভাবে ভাবিনি বা ভাবনাতে আসেনি। এখানে উল্লেখ না করলে নয়, ভাবনাটি আমার একান্ত ব্যক্তিগত। হয়তো অন্য কারো সাথে নাও মিলতে পারে অথবা অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে। তবে আমি এমনও মানুষ দেখেছি, বয়স হিসাবে গড়আয়ুর সময় পেরিয়ে যাবার পরেও জীবনের পিছনে না ছুটে, ছুটে চলেছে অর্থের পিছনে, যদিও অর্থই সকল অনর্থের মূল।

মানুষ মরণশীল যা চিরন্তণসত্য। আর এই মরণ বা মৃত্যু হচ্ছে জীবনের পরিসমাপ্তি। অর্থাৎ গতিশীল জীবন যেখানে থেমে যায় সেখানেই মৃত্যু। সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে সকল প্রাণির বিস্ময় ও রহস্যের নাম জন্ম এবং মৃত্যু। জন্মের সঠিক সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা গেলেও মৃত্যুর কোন সঠিক সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা যায়না। যদিও সকলেই অমরত্ব চাই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও চেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’। আবার তাঁকে এটাও লিখতে হয়েছে-

‘দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে

মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে।

জ্যেতির্ময়! তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি-

মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারে অন্য পথ নাহি’।