রোগী-ডাক্তার সম্পর্ক  বিলেত-বনাম বাংলাদেশ 

রোগী-ডাক্তার সম্পর্ক  বিলেত-বনাম বাংলাদেশ 

লন্ডনে অসুখ-বিসুখে ডাক্তারে যাওয়া হয় খুব কমই। শারিরীক কোনো সমস্যা দেখা দিলে নিজেই নিজের সমস্যা নিয়ে হালকা-পাতলা একটা গবেষণা করে নিই । বুঝার চেষ্টা করি কেন সমস্যা হচ্ছে? পর্যাপ্ত ঘুম হয়েছে তো? নিয়মিত ব্যায়াম করা হচ্ছে কি-না, খাবারে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি- ইত্যাদি  ইত্যাদি। 

গুগলে বিভিন্ন হেলথ ওয়েবসাইট ঘাটাঘাটি করি । বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শের আলোকে নিজের রোগের উপসর্গগুলো মিলিয়ে দেখি । এরপর প্রতিকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘরোয়া ওষুধপত্র খাই। অনেক সময় এতেই কাজ হয়ে যায় । এটা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যেস।

গত কয়েকমাস ধরে একটি সমস্যায় ছিলাম । কিছুদিন পরপরই পেটে অসুখ দেখা 
দেয় । তা স্থায়ী থাকে দিন চার-পাঁচেক। এই সময় খাবার হজমে অনিয়ম হয়। আরো বিবিধ সমস্যা থাকে। একটা অস্বস্তিকর অবস্থা মোকাবেলা করতে হয়। 

কিছু হেলথ ওয়েবসাইট চেক করে উপসর্গগুলো মিলিয়ে অনুমান করতে পারলাম আমার এই সমস্যাকে 'ইরিট্যাবল ভাওয়াল সিমট্রম' বলে । ওষুধ হিসেবে 'ম্যাবেভেরিন১৩৫ ' নামক এক ধরনের ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শও দেয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, লন্ডনে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশ ছাড়া ফার্মেসী থেকে ওষুধ কি-না যায় না । তাই জিপির (জেনারেল প্রাকটিশনার) শরনাপন্ন হতে হলো। 

জিপি সার্জারিতে ফোন করলে রিসিপশনিস্ট আমার নাম, জন্ম তারিখ ও মোবাইল নাম্বার রেখে বললেন, ডাক্তার আপনাকে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই কল করবেন । কথা মতো ঘণ্টা দুইয়েকের মধ্যেই কল করলেন ডাক্তার । ওপাশ থেকে ' ‌হ্যায়, হ্যালো' কুশলাদী জিজ্ঞেস করার পর সমস্যা জানতে চাইলেন তিনি। 

আমি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে তাঁকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম । তিনিও রোগের উপসর্গ সম্পর্কে বারবার বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকলেন । তাঁকে বললাম, সমস্যা নিয়ে আমি কিছু রিসার্চ করেছি। জানতে চাইলেন কীভাবে রিচার্স করেছি ? বললাম, কিছু হেলথ ওয়েবসাইট ঘাটাঘাটি করেছি। তাছাড়া একজন ফার্মাসিস্ট বন্ধুর সাথে কথাও বলেছি। 

বললেন, আপনার রিচার্সে কী মনে হয়েছে। বললাম, মনে হচ্ছে এই সমস্যাকে 'ইরিট্যাবল ভাওয়েল সিম্পট্রম' বলে। এই জন্য এক কৌস 'ম্যাবেভেরিন১৩৫ ' ট্যাবলেট খাওয়ারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। 

ডাক্তারা এবার আমাকে আরো কিছু প্রশ্ন করলেন। মিনিট খানেক কথা বলার পর বললেন, আমারও মনে হচ্ছে তা-ই। 'ইরিট্যাবল ভাওয়াল সিম্ট্রম'ই হবে । আমি প্রেসক্রিপশনে  'ম্যাবেভেরিন ১৩৫' লিখে দিচ্ছি। এখনই আপনার  রেজিস্টার্ড ফার্মেসীতে প্রেসক্রিপশন চলে যাবে (ইলেক্ট্রনিক্যালি) । ওষুধ নিয়ে যাবেন। বেশি খাবেন না। প্রয়োজন হলে খাবেন, নতুবা  খেতে হবেনা । 

ফার্মেসী থেকে ওষুধ নিয়ে এলাম এবং খাওয়া শুরু করলাম। যদিও এক সপ্তাহের কোর্স তবে দিন তিনেক খাওয়ার পরই সমস্যা অনেকটাই সেরে গেলো। 

ব্রিটেনে জিপির সাথে রোগীর এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক  অস্বাভাবিক কিছু নয় । তবে বিষয়টি নিয়ে লেখার একটি কারণ আছে। 

প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা । আমি সম্ভবত তখন সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেনীকে পড়ি। তখন আমার মা এভাবে কঠিন পেটের অসুখে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সম্ভবত পেটে টিউমার হয়েছিলো। পাথরের মতো কিছু একটা পেটের এপাশ থেকে ওপাশে ঘোরাঘুরি করতো । 

স্থানীয় পর্যায়ে ডাক্তার-কবিরাজের চিকিৎসা-তদবির শেষ করে বড় ভাই মাকে নিয়ে গেলেন সিলেটের একজন প্রখ্যাত ডাক্তারের (প্রয়াত) কাছে । ওই ডাক্তার ছিলেন এশিয়া মহাদেশের মধ্যে একজন নামকরা চিকিৎসক । সিলেট তথা বাংলাদেশের মানুষ  তাঁকে একনামে চিনতো । 

তো, চেম্বারে পৌঁছার পর সিরিয়াল মতো অপেক্ষা করতে থাকলেন । ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষার পর হঠাৎ মায়ের ডাক পড়লো । এবার তিনি পরম কৌতুহল ও আগ্রহ নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ডাক্তারের অ্যাসিসটেন্ট তাঁকে একটি চেয়ারে বসতে দিলেন। এরপর ডাক্তার সাহেব মায়ের বুকে-পিঠে স্ট্যাথেসস্কোপ লাগিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের অবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে হাতের কবজিতে ধরে কিছু একটা অনুধাবনের চেষ্টা করছিলেন । মা তখন তাঁর সমস্যার কথাগুলো খুলে বলতে যখন চেষ্টা করছিলেন, তখন ডাক্তার সাহেব ধমকের সুরে বললেন  "হেই বেটি তুই যদি ডাক্তার তাহলে আমার কাছে আইছছ কেনে"? 

মা ডাক্তারের এমন আচরণে থ হয়ে গেলেন। তিনি আর কোনো কথা বলার সাহস পাননি। মনের কষ্ট মনেই চাপা দিয়ে রাখলেন । ডাক্তার সাহেব প্রেসক্রিপশনে কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে বললেন, খাওয়া শেষ হলে আবার নিয়ে আসবেন। কিন্তু মাকে আর ওই ডাক্তার মহোদয়ের কাছে যেতে কিছুতেই রাজি করা যায়নি । বলেছিলেন, "মরলে মরবো। । এমন ডাক্তারের কাছে না যাওয়াই ভালো"। 

মাকে আরো অন্যান্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। কিন্তু কোনো চিকিৎসাই কাজে আসেনি। সম্ভবত পরপারের ডাক চলে এসছিলো। ১৯৯১সালের ৮ই নভেম্বর মাস ছয়েক শয্যাশায়ী থাকার পর পরালোক গমন করেন। (আল্লাহ তায়ালা তাঁকে যেন জান্নাতে সুখ-শান্তিতে রাখেন)।  

মায়ের সাথে ডাক্তারের সেই রূঢ় আচরণ আমাকে আজও পীড়া দেয় । ময়ের কথা যখনই স্মরণ হয় তখন ওই 'প্রখ্যাত' ডাক্তার সাহেবের কথা মনে পড়ে। জীবন-মৃত্যূর মালিক মহান প্রতিপালক । আয়ু শেষ হয়ে গেলে কেউ কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না । তবে ওইদিন ডাক্তার সাহেব যদি মায়ের সাথে সুন্দর করে কথা বলতেন তাহলে মা হয়তো মানসিকভাবে কিছুটা শান্তি পেতেন। 

ব্রিটেনের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে স্যালুট করতেই হয়। আমাদের দেশে যেখানে একজন রোগীকে তার সমস্যাটুকু বলতেই দেয়া হয় না, সেখানে এখানকার ডাক্তার রোগীর সমস্যা কান পেতে শুনেন তো বটেই; উপরন্ত রোগীর পরামর্শ অনুযায়ী রোগ নিরুপন করার চেষ্টা করেন, ওষুধও লিখে দেন। ডাক্তার যখন রোগীর সাথে এমন বন্ধুত্বপুর্ণ ব্যবহার করেন, তখন রোগীর তো ৫০ পার্সেন্ট রোগ এমনিতেই সেরে যায়। 

মায়ের ঘটনাটি যদিও ৩০ বছর আগের, কিন্তু এই ত্রিশ বছর সময়ে বাংলাদেশে কি রোগী-ডাক্তার সম্পর্কে কোনো উন্নতি ঘটেছে? সামগ্রিকভাবে বললে বোধহয় অনেকেই বলবেন- নাহ হয়নি।  

তবে আমার এ লেখাটি যদি বাংলাদেশে 'রোগী-ডাক্তার' সম্পর্ক উন্নয়নে ন্যুনতম ভুমিকা রাখতে পারে তাহলে নিজের চেষ্টাটুকু স্বার্থক মনে করবো । ছবি: প্রতীকী

তাইসির মাহমুদ
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
শনিবার, দোসরা অক্টোবর ২০২১