লাল শাড়ি (ছোট গল্প )

লাল শাড়ি (ছোট গল্প )

আব্দুল বাকী চৌধুরী 

“ঠিক এভাবেই তোমায় দেখতে ভালোবাসি
একলা এক বৈশাখী সন্ধ্যায়,
পশ্চিমা সূর্য যেমন নেভায় আলো
তেমনি নয়নে-নয়ন রাখি বলেছিলাম
‘শুধু তোমাকেই বাসিয়াছি ভালো’.……”
                               আজ এতো খুশি, সকাল থেকে  আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলো নীলিমা। সদ্য কিশোরী বয়স পেরিয়েই হুট করে বিয়ে করে ফেলে ভালবাসার মানুষটাকে। একদম ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসে বিলেতে বাঙালী বনেদী পরিবারের বড় বউয়ের স্থানটা তার কাছে বড্ড বেশি অচেনা। মাত্র আঠারো বছর বয়সে এতো এতো দায়িত্বে যেনো নিজেকে সাগরের পানির মাঝখানে ডুবে যাচ্ছে অনুভব করতো প্রতিটা দিন। 

প্রায়ই বকা শুনতে হতো সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না বলে, সেই সাথে রান্নাবান্নাতেও ছিলো ভীষণ আনাড়ি।  যে মেয়েটা বাবার বাড়ীর বড্ড আহ্লাদি ছিলো, ছিলো বাবার রাজকন্যা- কখনও চিন্তাও করতে পারেনি বিয়ে মানে শুধু ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পাওয়া নয়, রাজ্যের দায়িত্বও যে উপহার হিসেবে জীবনে নেমে আসে।

প্রায় প্রতি রাতই তার বালিশ জানতো কতো অশ্রু জমা তার দু’চোখে। ততদিনে চোখ দুটি যে তার গভীর সমুদ্রে রুপান্তরিত হয়েছিল।ভেজা চোখে ঘুমিয়ে সকালে নতুন উদ্যমে দিন শুরু করলেও কিছু না কিছু গরমিল রয়েই যেতো আর দিনশেষে মন খারাপ করেই বালিশ ভিজিয়ে ঘুমুতে হতো। সবকিছুর পরও গুমোট জীবনে মাতাল হাওয়ার আবেশ তাকে ছুয়ে যেত যখন ভালোবাসার মানুষটা ছুটির দিনে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাবার কথা বলতো।
আজকে তেমন একটা দিন। তানভীর কাজে যাবার আগে বলে গেছে বিকেলে বৈশাখের শপিং করতে নিয়ে যাবে, আর কাল দু’জনে বাংলা টাউনের বৈশাখী মেলায় একসাথে যাবে। নীলিমার আজ যেন কোন কটু কথাই কানে লাগছে না। করলা ভাজিতে রসুনকাটা দিয়ে বাগাড় দিয়েছে বলে শাশুড়ি বকছে , বকুক ! কোনভাবেই মন খারাপ করা যাবে না। প্রিয়মানুষটা যে মন খারাপ করা চেহারা দেখলে রাগ হয়ে যায়। আর তাকে রাগালেই বেড়াতে যাওয়া আর হবে না। কয়েক ঘন্টার মাতাল হাওয়া শরীরে জড়ানো হবেনা।

 বিয়ের পর থেকে প্রতিটাদিন যেমন পরীক্ষার মধ্যে নীলিমাকে যেতে হচ্ছে এর মধ্যে বেঁচে থাকা যে বড্ড কঠিন তাই তো মাঝে মাঝে মনের অক্সিজেন পাবার আর ভিতরের বিষাক্ত কার্বনডাইঅক্সাইড নির্গমনের আশায় ভালোবাসার মানুষটার সাথে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে। যেই বন্ধের দিন তানভীর তাকে ফেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় যেতো সেইদিনগুলো  নীলিমার জন্য সবচেয়ে বেশি মন খারাপ করা দিন থাকতো। ভীষণ অভিমান হতো কিন্তু তেমন কিছু বলতো না। নীলিমা তার বাবাকে যে বাজি ধরে বলে এসেছিলো “খুউবববব সুখে থাকবো দেখে নিও, বাবা”। তাইতো প্রতিনিয়ত সুখে থাকার অভিনয়টাই রপ্ত করে গেছে এবং এই ব্যাপারে শতভাগ জয়ীও হয়ে গেছে নীলিমা।

ভালোবাসার মানুষটার সাথে গ্রীন স্ট্রিটের শাড়ির দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে একটা লাল শাড়ি কিনলো নীলিমা। তানভীর সেই প্রেমকালীন সময় থেকে বলে এসেছিল “লাল শাড়িতে তোমায় পরীর মতো লাগে, খবরদার আমি ছাড়া কখনও লাল কিছু পরবে না, আমি যখন সাথে থাকবো তখনই লাল শাড়ি পরবে, মনে থাকবে”? 
এরপর থেকে কখনও লাল শাড়ি পরে না নীলিমা, কেবল তানভীরের সাথে বের হলেই লালে নিজেকে সাজিয়ে নেয়। বিয়ের পরের প্রথম বৈশাখ। শাশুড়ি বলে দিয়েছিল শাড়ি যেন লালই হয়। অবুঝ মনে প্রশ্ন করে বসে “আচ্ছা এখন লাল শাড়ি পরতে পারবো তোমাকে ছাড়া”?
মানুষটা শান্ত চোখে তাকিয়ে বলে “কেবল মায়ের সাথে কোথাও গেলে পরো কেমন?”
 নীলিমা মনে মনে হাসে, বিয়ের পর থেকে সে তো কোথাও যায়ই না।এ বাড়ির বউদের কোথাও যেতে নেই পরিবার বা স্বামী ছাড়া। নীলিমা লাল শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে চুড়ি, কানের দুল, নাকের নথ, টিপের পাতা কেনে, পায়ের নুপুরও কেনে;  তারপর  গ্রীন স্ট্রিট থেকে পায়ে হেটে দু’জনে রমফোর্ড রোডের ‘পাম বীচ’ রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। ফেরার পথে তানভীর তাকে এগারোটা বেলীফুলের মালা কিনে দেয়। আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরে ভালোবাসাময় দুটি হৃদয়।
প্রায় দেড়যুগের সবক’টা বৈশাখ কেটে যায় নীলিমার এ বাড়িতে। তার এখন আর ভেজা বালিশে ঘুমুতে হয়না। সকালে দেরী করে উঠলে বকাও খেতে হয়না।কেউ গায়ের চাপা রং নিয়ে কটু কথাও শোনায় না। একদন্ড নিঃশ্বাস নেবার আশায় ছুটির দিনের অপেক্ষা করার অভ্যসটা বহু আগেই পরিবর্তন করেছে নীলিমা। হুটহাট লাল শাড়ি পরে একাই বের হয়ে যেতে কেউ আর টোকারাও দেয় না। সে যে এখন ভীষণ শক্ত।কেউ চাইলেই তাকে যা ইচ্ছে তা বলে দেবার আগে ভেবে নেয়।সে শিখে গেছে মাথা উঁচু করে বাঁচতে।জেনে গেছে নিজের পছন্দকে মূল্য কি করে দিতে হয়। মেরুদন্ড সোজা করে স্বাবলম্বি হবার পথটাও সে নিজেই খুঁজে বের করেছে। 
নীলিমা এখন জানে সবার আগে নিজেকে ভালবাসতে হয়।নিজের মনের যত্ন নিতে হয় তারপর সবার কথা ভাবতে হয়।মনের যত্ন না নিলে, মন যে মারা যায় এবং মরা মন নিয়ে এ জীবনে কিছুই করার থাকে না কেবল মানুষের করুণা পাওয়া ছাড়া।করুণাময় জীবন যে ভয়াবহ কষ্টের। করুণা করবে একমাত্র আল্লাহ্। মানুষ যখন মানুষ কে করুণা করে তখন মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ে। সোনা যেমন পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনায় রুপান্তরিত হয়, তেমনি নীলিমাও একজীবন কষ্ট, বেদনা, কাঁটা বেছানো পথ পাড়ি দিয়ে নিজেকে ভেঙ্গেচুড়ে আজকের শক্ত মানুষে পরিণত করেছে।
আজ বৈশাখের প্রথম দিন।আঠারো বছর আগে আনন্দিত মন নিয়ে গ্রীন স্ট্রীট থেকে কেনা সেই লাল শাড়িটা সে আজ গায়ে জড়িয়েছে।সেই আগের মতো কিশোরী সৌন্দর্য তার মাঝে আর নেই কিন্তু আছে কঠিন একটা আত্মবিশ্বাস, আছে নিজের প্রতি ভরসা, আছে তার উপর নির্ভরশীল এক ঝাক মানুষ।
এই শাড়ি গায়ে জড়িয়ে অনেক স্মৃতি তাকে প্যাঁচিয়ে ধরেছে।মনে করিয়ে দিচ্ছে তার সাথে ঘটে যাওয়া ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অবিচার। তারপরও আজ সে এমন একটা অবস্থানে আছে যে গ্রীবা উঁচু করে বলার মত সাহস রাখে “আমি ভাল আছি, বেশ ভালো আছি”। 
ঐ যে বাড়ি ছাড়ার আগে বাবাকে যে বলে এসেছিলো বাজি ধরেছিল “খুউববব ভালো থাকবো দেখে নিও, বাবা”। নীলিমা যে বাজিতে বিজয়ী হয়ে বাবাকে হারাতে পেরেছে এই মিথ্যা শান্তনাটাই তো যথেষ্ট একটা জীবন কাটিয়ে দেবার জন্য॥

#ছোটগল্প_লালশাড়ি