সেদিন ছিল ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮,

সেদিন ছিল ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮,

মনিরুজ্জামান 


 ১৮তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারের জন্য মনোনীত হয়ে কখনো ঢাকা, কখনো বাড়িতে দিনগুলো কাটছিল আমার।  অপেক্ষা করছিলাম মেডিকেল টেস্টের জন্য। বাড়িতে থাকতেই চিঠি পেলাম আমার মেডিকেল টেস্ট নির্ধারিত হয়েছে ২২ শে সেপ্টেম্বর,১৯৯৮।

 আমাদের বাড়ি থেকে ৩/৪ কিলোমিটার দূরের নাভারন থেকে আমরা সাধারণত ঢাকার বাসে উঠতাম। ৯ টার বাসে আমার টিকেট করা ছিল। আব্বা তখন একটা হোন্ডা ৫০ সিসি মোটর সাইকেলে বাড়ী থেকে নাভারনে স্কুলে  যাওয়া আসা করতেন। সাধারণত বাড়িতে থাকলে আমিই আব্বাকে মোটর সাইকেলে আনা-নেওয়া করতাম। আমাদের লাল রঙের হোন্ডা  CDI 100 ব্রান্ডের আরো একটা মোটরসাইকেল ছিল। আমরা দু ভাই চড়তাম। ওটা ছিল আমার কৈশোর আর তারুন্যের ড্রিম রাইডার।

 ঢাকা আসার সময় আমার সাথে ব্যাগ-ট্যাগ ছিল। বাড়ী থেকে আসার পথে মা প্রায়ই এটাসেটা দিয়ে দিতেন বলে মোটর সাইকেলে বাসস্ট্যান্ডে না গিয়ে একটা ভ্যান রিক্সায় বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আব্বাকে বললাম আব্বার 50 হোন্ডাটা নিয়ে যেতে, যাতে করে বিকালে বাড়ি আসতে আবার কষ্ট না হয়। 

আব্বা খুব গোছানো মানুষ ছিলেন। আবুসাম নামে  একটা ছেলে ছিল আমাদের বাড়িতে  কাজ করতো।আব্বা ওকে বলল মোটরসাইকেল মুছতে। সকাল ৮ টার দিকে বাড়ি থেকে বের হব। মালপত্র ভ্যানে উঠানো হয়েছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। আব্বাও তার মোটরসাইকেল নিয়ে প্রস্তুত আমাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিবেন। হঠাৎ কি মনে করে আব্বা বললেন শরীরটা ভালো লাগছে না, আজ মোটরসাইকেল নিবোনা, চল তোর সাথে ভ্যানে যাই।

 আব্বা খুব ধীর স্থির, ঠান্ডা মাথার মানুষ ছিলেন, হুটহাট করে সিদ্ধান্ত নিতেন না, পরিবর্তনও করতেন না সহসা। সবাই একটু অবাক হল। আমার কেন জানি মনে হলো আব্বা আসলে এই সময়টুকু আমার সাথে কাটাতে চাচ্ছেন। যাহোক২০/২৫ মিনিটের মধ্যেই বাসস্ট্যান্ডে পৌছালাম।  কাউন্টার ম্যানেজার এলাকার পরিচিত মানুষ। বলল ভাই বেনাপোলে গাড়ি আটকে আছে ঘন্টাখানেক দেরি হবে। কাউন্টারে বসেই ম্যানেজার সাহেবের অফার করা চা খেলাম আমি আর আব্বা।

 যতবারই বাড়ী থেকে বিদায় দিতেন ততোবারই শেষ সময় আব্বা আলাদা করে ভাজেভাজে ৫০০/১০০ টাকার নোট আলাদা দিতেন মাসের খরচের জন্য, আর ১০/২০ টাকার নোট কতগুলি দিতেন হাতখরচ, পথ খরচের জন্য। এবং নিজে হাতে দোকান থেকে  বিস্কুট, কলা, আপেল কিনে দিতেন পথে খাবার জন্য।

 বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, চাকরিও হয়ে গেছে তারপরও বারবার বলতেন পথে যেন কিছু না কিনে খাই,অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু না খাই ইত্যাদি ইত্যাদি। মা তো বাড়ি থেকে রান্না করার কিছু খাবার দিতেনই পথে খাবার জন্য। রুটি, আলু ভাজি, ডিম ভাজি বা সিদ্ধ, তেলের পিঠা এসবই সাধারণত। 

বাস আসতে দেরি হবে ঘন্টাখানেক। আব্বাকে বললাম স্কুলে চলে যেতে। আমার সাথে আমার এক বন্ধু ছিল। আব্বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও গেলেন। দেখলাম ভ্যানে উঠেও আব্বা বারবার পিছনে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছেন। আমার মনটাও কেন জানি খুবই বিষন্ন হল। বাস স্ট্যান্ড থেকে আব্বার স্কুল ৫/৭ মিনিটের পথ। 

২০/২৫ মিনিট পড় আব্বা আবার চলে আসলেন বাস কাউন্টারে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নিজে থেকে বললেন পোস্ট অফিসে কাজ আছে তাই যাচ্ছি, এদিক দিয়েই তো যেতে হয়।স্কুলে একটা পিয়ন ছিলো। পোস্ট অফিসের কাজে আব্বার নিজে যাবার কথা নয়। আমি বুঝলাম আব্বা আমার সাথে সময় কাটাতে চাচ্ছেন। কিছু বললাম না। অন্য সব ভাইবোনদের চেয়ে  আব্বার কাছ থেকে পাওয়া এই বাড়তি অনুরাগ টুকু বরাবরই ছিল সন্তান হিসেবে আমার অন্যতম অহং।সেটুকু আমি প্রাণভরে উপভোগ করতাম।

কাউন্টার ম্যানেজার ও আব্বার ছাত্র। খুব আদর আপ্যায়ন করে চেয়ার ঝেড়ে মুছে বসতে দিলেন আব্বাকে। বাবা-ছেলে পাশাপাশি বসে কাঁচের গ্লাসে বেশি করে দুধ দেয়া রাস্তার পাশের দোকানের সুস্বাদু এক কাপ চা খেলাম। সেই এককাপ দুধ চাই আব্বার সাথে খাওয়া জীবনে আমার শেষ খাবার। 

আব্বা হার্টের রোগী ছিলেন। দুধ চা খাওয়া তার নিষেধ ছিল। কিন্তু আব্বা তা মানতেন না, চা খেলে দুধ চা খেতেই পছন্দ করতেন।এই কারনেই আমার কাছে এখনো দুধ ছাড়া অন্য কোন চা কেই চা বলেই মনে হয় না,দুধ চায়ের এত দোষ জানা স্বত্বেও।

এক সময় বাস আসলো, জানালার পাশেই আমার সিট ছিল।বাসে উঠলাম। আব্বা যথারীতি বাসের জানালার পাশে দাঁড়ানো। সাদা পাজামা আর আকাশী নীল পাঞ্জাবি পরা। ঘন, বেশিরভাগ সাদা চাপ দাঁড়ি,চোখে সোনালী চকোলেট মিক্সড কালারের চশমা।

 বিষন্ন মনে আমাকে বিদায় দিলেন। বললেন গিয়ে চিঠি লিখিস, মেডিকেল টেস্ট দিয়েই বাড়ি চলে আসিস।আহারে! তখন যদি জানতাম মেডিকেল টেস্ট দেওয়ার আগেই আমাকে আব্বার মৃত মুখ দেখতে হবে তাহলে কি আর আসতাম!

"চিঠি লিখিস, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসিস" এটাই ছিল আমার জন্য আব্বার শেষ কথা। বাস ভর্তি লোক, অনেকেই পরিচিত, বেনাপোল বা নাভারনের যাত্রী, চেনা মুখ। দলা পাকিয়ে কান্না আসছিল,অন্যদিকে তাকিয়ে  চাপলাম সে কান্না।

 আব্বা তখন নানান বিষয়ে  ভীষণ চিন্তিত ছিলেন। শরীর অসুস্থ্য,প্রায়ই বাড়ে বুকের ব্যাথা,হাঁটতে ঘুমাতে কষ্ট হয়। আর্থিক ভাবেও চরম টানাপোড়েন চলছিল আব্বার। আমরা ৪ ভাই বোন একসাথে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি,  খরচ অনেক। সব মিলিয়ে নানা অসুবিধায়  ছিলেন আব্বা। 

 খুব চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন।পারতপক্ষে কাউকে বলতেন না নিজের অসুবিধার কথা। আব্বার স্কুলে, সারের দোকানে, রাইস মিলের অফিসে বা মোটরসাইকেলে যাওয়া আমার পথে টুকটাক করে আমাকে বলতেন একটু একটু করে। আমি খালি একটি কথাই বলতাম, বেশি চিন্তা করবেন না আব্বা, সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন বুঝতামনা,আসলে সবকিছু কখনোই ঠিক হয় না। কিংবা হয়তো সবই ঠিক হয়ে যায়, কিন্তু তখন আর সময় থাকেনা। 

বিদায়  বেলায় আমি খালি বললাম আব্বা শরীরের যত্ন নিয়েন, আমার চাকরি হয়ে গেছে,বেশি চিন্তাভাবনা করবেন না,এখন তো একটু হলেও দায়ীত্ব নিতে পারবো। আমি গিয়েই চিঠি লিখব, ২২ তারিখ মেডিকেল টেস্ট দিয়ে রাতেই বাড়ী চলে আসবো।

ঢাকায় আসলাম। তখন আমরা ৪ বন্ধু মিলে আজিমপুর পুরানো পল্টন লেনে দুই রুমের একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকতাম তখন। ২২ সেপ্টেম্বর আমার মেডিকেল টেস্ট। এর আগে নানা রকম টেস্ট করাতে হয়, করি। খোঁজখবর নেই মেডিকেল টেস্ট কেমন হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। দু-তিন দিন কেটে যায়। চিঠি লিখতে ভুলে যাই। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। মাঝে মাঝে যশোর শহরে চাচার বাসায় ল্যান্ড ফোনে ফোন করে খোঁজখবর আদান-প্রদান হত। প্রতিদিনই কেউ না কেউ গ্রাম থেকে চাচার বাসায় আসতো। কাজেই আব্বা মার খোঁজখবর দেওয়া নেওয়ায় সমস্যা হতো না। 

১৬ তারিখে আব্বার চিঠি পেলাম। সন্ধ্যার পর বাসায় ঢুকতেই আমার রুমমেট/ বন্ধু তবিবুর (বর্তমানে ডেপুটি সেক্রেটারি) বলল স্যার এর চিঠি এসেছে। তবিবুর সরাসরি আব্বার ছাত্র না হলেও আমাদের একই এলাকার। ও আব্বার হাতের লেখা চিনতো। গোটা গোটা হরফে মোটা ফাউন্টেন স্পেনে হলুদ খামের উপর কালো কালিতে লেখা মোঃ মনিরুজ্জামান বেল্টু,--- পুরানো পল্টন লেন, আজিমপুর, ঢাকা---। 

কাপড় চেঞ্জ না করেই আব্বার চিঠি খুললাম, পড়লাম। বরাবরই আব্বার লেখার হাত ছিল অসম্ভব ভাল। বাংলা ভাষায়  হালকা-পাতলা যতটুকু মনোভাব প্রকাশ করতে পারি তার হাতেখড়ি  আব্বার হাতেই,আব্বার কাছ থেকেই শেখা। 

আমাকে লেখা আব্বার চিঠিগুলো আমি দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ করেছি। হারিয়ে গেছে অনেক গুলো,বারবার জীবনের ঘাট পাল্টানোর কারণে। এখনো পড়ি দুয়েক টা বের করে। কত কিছু যে আছে তাতে,মায়া, মমতা, স্নেহ, দায়িত্ববোধ, শিক্ষা, দেশপ্রেম,মুল্যবোধ আরো কত কিছু!!

১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ তারিখে পাওয়া সে চিঠিই আব্বার সাথে আমার শেষ পার্থিব যোগাযোগ। গোটা গোটা কালো রঙের হরফে লেখা শুভাশিষ নিয়েই কাটাতে হবে বাকিটা জীবন। 

এখনো চোখে ভাসে 11september রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে আমার বাস চলেছে ঢাকার পথে আর আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন বাসস্টান্ডে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে তাকিয়ে আছি ক্রমশঃ ছোট্ট হয়ে আসা আমার পৃথিবী, আমার বাবার দিকে। একসময় আবার আকাশী নীল পাঞ্জাবি দিগন্তে হারিয়ে গেল, আমার দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে এলো। তখনো কি জানতাম এদেখাই শেষ দেখা হবে?

২২ বছর হয়ে গেল। এখনো সে কথা ভাবলে চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে। নিজের অজান্তেই চাপা কষ্টগুলো চশমার ফাক দিয়ে লোনা জল হয়ে গলে পড়ে অঝোর ধারায়, তারপরও মন শান্ত হয় না। কি যেন কি খুঁজি,কিন্তু পাইনা।জানি পাবো ও না আর কোনদিন।

রাত পোহালেই ২০ সেপ্টেম্বর। আমার আব্বা জনাব খান কবির আহমেদ, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, নাভারন রেল বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর ২২ তম মৃত্যু বার্ষিকী। 

২২ টি বছর অনেক সময়। এখনো মন খারাপের দিনে আব্বার কথাই মনে হয়। অনুভব করি যাপিত পার্থিব জীবনের  সবচেয়ে বিশ্বস্ত সিঁড়িটাই আর নেই। আমরা যখন ছোট, তখন ছুটির দিনে আব্বা সকালে মাঠে যেতেন জমিজমা দেখতে। দুপুরের আগে বাড়িতে এসে উঠানে গাছ তলায়, ছায়ায়, চেয়ারে, পিঁড়িতে বা বিছানায় বসতেন। আমাদের কাজ ছিল সেই শীতল ছায়ায় তালপাতার পাখায় আব্বাকে বাতাশ করা।
 সেই শৈশবেও অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ পেতাম আব্বার শরীর থেকে। এখনো চোখ বন্ধ করলে সে গন্ধটুকু পাই। এখনো প্রায়ই স্বপ্নে দেখি আমি বাসের জানালা দিয়ে চেয়ে আছি, ক্রমশ দিগন্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আব্বার আকাশী নীল পাঞ্জাবি। মন খারাপের দিনে বারবার টেনেটেনে শুনি প্রিয়গায়ক জেমসের দরাজ গলার গানের পংক্তি টুকু,

"বাবা, কতদিন 
কতদিন দেখিনা তোমায়......."

রাব্বুলআলামিন,পরোয়ার দিগারের কাছে আব্বার জন্য কত কাঁদি,কিন্তু মন শান্ত হয়না।জানিনা কেমন আছেন,কি অবস্হায় আছেন আজন্ম সংগ্রামী মানুষটি।যতটুকু দেখেছি পরহেজগার,দায়ীত্বশীল,পরোপকারী মানুষটি সারাজীবন সকলের কল্যাণে কাজ করেছেন।নিজের পরিবারের বাইরেও সাধ্যমত, এমনকি কখনো কখনো সাধ্যের অতিরিক্ত মানুষের বোঝা বয়েছেন।এজন্যই এখনো পর্যন্ত আব্বার আমার জীবনের অন্যতম আইডল।

নিশ্চয়ই রাব্বুল আলামিন আব্বাকে বেহেশতের উচ্চতম স্হানে অধিষ্ঠিত রাখবেন,আব্বার কবরের জীবন শান্তিময় হবে সন্তান হিসাবে এ প্রার্থনাই করি।আত্মীয় বন্ধু,স্বজন,শুভানুধ্যায়ী সকলের কাছে আমার জনমদুখী আব্বার জন্য দোয়া চাই।পরোয়ারদিগার আব্বাকে ক্ষমা করুন,দয়া করুন,কবুল করুন,যত্নে রাখুন।

রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বি ইয়ানি সগিরা।