সিলেটে সড়কেই শেষ ফুডপান্ডা কর্মীর স্বপ্ন  

সিলেটে সড়কেই শেষ ফুডপান্ডা কর্মীর স্বপ্ন  

মো. ফয়ছল আলম::

চারদিন আগে সৎকার করা হয়েছে কলেজ ছাত্র বিশ্বজিতকে। এখনও তার সাইকেল পড়ে আছে ঘটনাস্থলে। চারদিনেও পুলিশ বা তার কর্মস্থলের কেউ ঘটনাস্থলে যাননি। অপরদিকে পুত্র হারানোর শোকে বার বার মুর্চ্ছা যাচ্ছেন বিশ্বজিতের মা কল্পনা রাণী দাস। যে ছেলে স্বপ্ন দেখতো ইঞ্জিনিয়ার হবে, বিদেশ যাবে, পরিবারের দু:খ ঘোঁচাবে। একটি সিএনজি অটোরিকশার ধাক্কায় সেই ছেলের জীবন প্রদীপ নিভে যাবে এমনটি তার মায়ের কল্পনায়ও ছিলো না। 

কলেজছাত্র বিশ্বজিতের বাড়ি শাল্লা উপজেলার শিবপুর গ্রামে। বাবাহীন পৃথিবীতে বিশ্বজিত তার মা আর ভাইয়ের সাথে থাকতো সিলেট নগরের আখালিয়া হাওলাদারপাড়ায় দুসকী সড়কের পাশে চা বাগান ঘেষা একটি কুঁড়ে ঘরে। মা, এক ভাই, বৌদি আর এক ভাতিজিকে নিয়ে ছিলো বিশ্বজিতদের সংসার। সিলেট নগরের টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিলো তার। লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিবারের খরচ জোগাতে কাজ করতো ফুডপান্ডায়। গত ২০ মার্চ রাত ১১ টার দিকে উপশহরে একটি অর্ডার ডেলিভারী দিয়ে সাইকেলযোগে বাড়ি ফিরছিলো বিশ্বজিত। হঠাৎ সোবহানীঘাট কাঁচাবাজারের সম্মুখে আসামাত্রই একটি সিএনজি অটোরিকশা তার সাইকেলকে ধাক্কা দিলে বিশ্বজিত সড়কের মাঝখানে পড়ে যায়, আর তখনই একটি চলন্ত কাভার্ড ভ্যান তাকে চাপা দিয়ে চলে যায়। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কয়েকঘন্টা পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বিশ্বজিত। 

বিশ্বজিতের ভাই চন্দন দাস জানান, তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর খবর পেয়ে তারা দ্রুত ছুটে যান। কিন্তু সেখানে তার বুকের বাম পাশের হাতের অংশটি থেতলে যায়। ফলে তাকে বাঁচানো যায়নি বলে জানান চিকিৎসকরা। মৃত্যুর আগে কথা বলতে পারছিলো বিশ্বজিত। এসময় সে বাঁচার জন্য বার বার আকুতি জানাচ্ছিলো। কিন্তু বাঁচানো গেলোনা। আমরা বাধ্য হয়ে বাড়তি ঝামেলায় না গিয়ে বিনা ময়না তদন্তে সৎকার করার আবেদন করি। সে আবেদন মঞ্জুর হলে পরদিন আমরা শেষ সৎকার সম্পন্ন করি। 

বিশ্বজিতের মামা সুশীল তালুকদার বলেন, ঘটনার পর তারা সোবহানীঘাটে কাচা বাজারের ওখানে গিয়েছিলেন। সাইকেলটি সেখানেই পড়ে আছে বলে জানান তিনি। বলেন আমরা সেটি আনিনি। যদি পুলিশ খোঁজে। কিন্তু গত চারদিনেও পুলিশের কেউ ঘটনাস্থালে যায়নি। যায়নি তার পরিবারের কাছেও। স্থানীয় কাউন্সিলর কিংবা অন্য কেউ সমবেদনা জানাতেও যাননি। লিখিত আবেদনে তারা লিখে দিয়েছেন তারা কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে চান না। তিনি জানান ঘটনার পর চালক সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে গেলেও তার নম্বরটি প্রত্যক্ষদর্শীরা রেখেছেন। যেটি জিডিতে উল্লেখ রয়েছে। দূর্ঘটনার সাথে জড়িত অটোরিকশার নম্বর হচ্ছে ১১-৮৬১২।  

বিশ্বজিতের ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে কোম্পানীর ডেলিভারি দিতে গিয়ে বিশ্বজিত মারা গেলো তারা কেউ এ পর্যন্ত তাদের বাসায় যাননি বা কেউ খোজ নেননি। কেউ একজন ফোন করে বলেছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। আমরা সাদাসিদে মানুষ, কার সঙ্গে যোগাযোগ করব,কোথায় যাবো। তাতো কিছুই জানিনা।

এ প্রতিবেদক যখন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আখালিয়া দুসকীতে তাদের বস্তিতে যান তখন সেখানে কান্নার রোল উঠে। বিশ্বজিতের বড় ভাইয়ের চার বছর বয়েসী মেয়ে আছে। যার নাম অপূর্বা। কোনো অবস্থাতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছিলো। পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রতিদিন বাসায় আসার সময় বিশ্বজিত অপূর্বার জন্য কিছু না কিছু একটা হাতে নিয়ে বাসায় ফিরতো। আজ তিনদিন ধরে বিশ্বজিতও ফিরে না। অপূর্বার কান্নাও থামেনা। বিশ্বজিতের মা কল্পনা রানী খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। পুত্রের কথা বললেই বিলাপ করে কেঁেদ লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। এসময় তারা বিশ্বজিতের কলেজের আইডি কার্ড, বিভিণœ ছবি, স্কাউটিংয়ে বিশ্বজিতের কৃতিত্বের বিভিন্ন সনদ দেখিয়ে জানান, তাদের বিশ্বজিত কলেজেও সুনাম কুড়াতো, লেখাপড়ায় ভালো ছিলো। আজ সব শেষ।

এদিকে গতকাল বিকেলে সোবহানীঘাটে ঘটনাস্থলে গেলে বাচ্চু মিয়া নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, অল্পের জন্য ছেলেটি ঘটনাস্থলে মারা যায়নি। কাভার্ডভ্যানটি ব্রেক না করলে সে পিষ্ট হয়ে যেতো। ঘটনার পরই যখন ছেলেটিকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত তখন কাভার্ড ভ্যান ও সিএনজি অটোরিকশাটি পালিয়ে যায়। 

কোতোয়ালী থানায় যোগাযোগ করা হলে কর্তব্যরত কর্মকর্তা বলেন, কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিনা পোস্ট মর্টেমে লাশ সৎকারের সুযোগ দেয়া হয়েছে।