সিলেটের হারিয়ে যাওয়া উৎসব 'বুলাবুলি'

সিলেটের হারিয়ে যাওয়া উৎসব 'বুলাবুলি'

আবু বকর সিদ্দিকী--

আজ ১ লা অগ্রাহয়ণ, নবান্নের প্রথম দিন। আজকের এই দিনে কৃষকগৃহে বয়ে যায় আনন্দের জোয়ার। বাঙালি তাদের চিরচেনা আয়োজনে বরণ করে এদিনকে।কষ্টের ফসল ঘরে তুলে আনতে তাদের মনে যে আনন্দের শিহরণ জাগায়,তা ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম হতে গ্রামান্তর।

বাঙালি সংস্কৃতি নানান রসে রুপে সমৃদ্ধ। হাজার বছরে চলে আসা এ সংস্কৃতি কালের পরিক্রমায় আজ বিলীন হওয়ার পথে। সুরমা- কুশিয়ারা উপাত্যকায়ও রয়েছে হাজার বছরের পুরনো শত কৃষ্টি-সংস্কৃতি। যা বহমান ধারায় এ কাল পর্যন্ত সমাদৃত। এতদঞ্চলে হিন্দু মুসলিম সংস্কৃতিতে অনেক উৎসব রয়েছে যা সমান ভাবে পালিত হয়ে আসছে। আবার অনেক উৎসব রয়েছে যা সবার কাছে সমান পালনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

কালের পরিক্রমায় আজ বিলীন হয়ে যাওয়া সিলেট একটি উৎসব হলো 'বুলাবুলি উৎসব'।আমার সহ অনেকের শৈববের এক স্মৃতি জাগানিয়া উৎসব এটি।

বুলাবুলি উৎসব কী? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, ''মূলত পুরনো বছরে রোগ অসুখ মুক্তি লাভের কামনায় পালনীয় এক প্রকার রীতি যা কলাগাছের পাচল দিয়ে একে- অন্যের গায়ে আঘাত দিয়ে সারানো হয়।'' বিশেষ করে কার্তিক মাস অপয়া কিংবা বদ মাস নামে প্রচলিত। তাই এ মাসের সকল অপয়া দূর করতে এই বুলাবুলি উদযাপন হতো।

চিরায়ত লোকসংস্কৃতি ইতিহাসের যদিও এই উৎসবের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কথামালা নেই তবুও এই উৎসব বিষয়ে এ অঞ্চলের মানুষের ছিলো তুমুল আগ্রহ।

লোকমুখে প্রচলন ছিলো নানান উপকথা।মূলত রস বা ঢঙের সম্পর্ক যাদের সাথে তাদের রসিকতার চলে এই কলার পাতার পাচল দিয়ে আঘাত করা হয়। যেমন ভাবি- দেবর - ননদ,নানা- দাদা-দাদী-নানী সাথে নাতি নাতনীর, দুলাভাইর সাথে শ্যালক-শ্যালিকার।

সবচেয়ে মজা ছিলো এ বিষয়ক ছড়া, " যেমন, "বুলা ছাড় বুলি ছাড় বারো মাইয়া পিছাইয়া ছাড়।'

"ভাত খাইয়া লরচর পানি খাইয়া পেট ভর" ইত্যাদি। এই কথার অর্থ হিশেবে বলা যায়, বারো মাসের যতো রোগব্যাধি আছে তা এই পাচলের আঘাতে দূর যেন হয়। গ্রামে এই চিরাচরিত প্রথাকে কেন্দ্র করে আয়োজন চলতো গোপনে বিশষ করে যাদের সাথে রস সম্পর্কীয়। ভাবিদের উপর বেশী আক্রোশ থাকতো।তাদের আক্রমনের জন্য লুকিয়ে চলতো পাচল তৈরীর কাজ।বিকেলে কখনো দল বেঁধে কখনো গোপনে হুমড়ি খেয়ে পড়তো এদের উপর।ভাবিরা কম যেতেন না কারণ তারা পূর্ব বছরের অভিজ্ঞতায় লুকিয়ে রাখতেন কলার বড়ো বড়ো পাচল। কোন কোন ভাবিকে দেবর ননদরা ভয় পেত অসীম ।

ঐ ভাবিদের কাছে যেতে সাহস করতো না অনেকে। তবে বেশী আক্রমন করা হতো নতুন দুলা ভাই- ভাবিদের যারা হয়তো এই অভিজ্ঞতায় কখনো পড়তে হয় নি। আবার অনেক ভাবি ঐ দিন দরজা লাগিয়ে রাখতেন মধুর অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেতে। অনেক ভাবিরা মরিচ পানি গোলে জানালা দিয়ে ছিটিয়ে দিতেন হামলাকারী দেবর- ননদের উপর।

দেবরা তো আর কম যায় না তারা কলার পাচলের বদলে নিয়ে আসতো মানকচু পাচল।যা দিয়ে বাড়ি দিলে চুলকাতো সারারাত। অনেকে বিশেষ গাছের পাতা যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলে 'চুতরা পাতা' সেগুলো লাগিয়ে দিতো গায়।

এতো সব মধুরতা আর ভালোবাসা পালিত হতো বুলাবুলি। 

হিন্দু ধর্ম মতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় গ্রামের অনেক মুসলিম মুরব্বিরা একে না পালন করতে বলতেন।তবু কে শুনেতো তাদের কথা। ঐ দিন বুলাবুলি উৎসব পালন ই যেন মূখ্য। 

সকালে ঘরের গরু বের করে গোসল করিয়ে নেয়া হতো

সন্ধেবেলা গরু ছাগলকে পাচল দিয়ে পিটিয়ে ঘরে তুলা হতো। যাতে এরা সারা বছর রোগমুক্ত থাকে।আসছে বছর যেন গাভীটা আবার বাচ্চা দেয়।

হিন্দু বাড়িগুলোতে তৈরী হতো মাটির তৈরী পাখি। বিভিন্ন জাতের পশু। মাটির ঘটি গুলো তাদের অনুষঙ্গ। আলপনা আকাঁ হতো বাড়ির আঙিনায়। এক ধরনের ফানুস ছেড়ে দেয়া হতো আকাশে। 

ছোটো বাচ্চার খুব সকালে হিন্দু বাড়িগুলো যেতো মাটির পাখির আশায়, ঘটির আশায়। যে যতো ভোরে যেত সে ভালো এবং সুন্দর ঘটি পাখি ও পশুগুলো পেত। 

পুরোদিনে কোথাও চলতো আরেক মজার আয়োজন, তাহলো 'টুপাটুপি'। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল তরিতরকারি সংগ্রহ করে, জাল দিয়ে মাছ ধরে রান্না করা হতো। কলা পাতায় খাওয়ানো হতো সবাইকে। কারো বাড়ি হতে চাল তো কারো বাড়ি থেকে নুন। এভাবে সব উপকরণ নিয়ে দিনভর আয়োজনে পাড়াময় চলতো হই হুল্লোড়। 

বিশেষত কলাপাতা দিয়ে ঘর বানিয়ে একে অন্যের ঘরে দাওয়াতে যেত।যদিও এগুলো ছোটদের বিষয় ছিলো তবে টুপাটুপিতে বড়োরাও যোগ দিতেন।

হাটবাজারেও বুলাবুলির বিশেষ আয়োজন।মাটির তৈরা পাখি,ষাঁড়, বাঘ সহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি নিয়ে গলিগুলোতে বসতো দোকানী মেলা। সে গুলো কেনার জন্য বাবা-চাচাদের সাথে বাজারে যাওয়ার বায়না থাকতো ছোটদের।

এতো সব আয়োজন আজ বিলীন।কালেভদ্রে ও তার খোঁজ মিলা দুষ্কর। গ্রামীণ সামাজিক এ বন্ধন আজ হারানো শেষপ্রান্ত। বুলাবুলির মতো আয়োজনগুলো এখন চোখেই পড়ে না।আগামী প্রজন্মের কাছে এটা মনে এটি কোন রুপকথার গল্প। সমাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এখন এই সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখা আমাদের প্রয়োজন।বাঙালি সংস্কৃতির বিশেষত্ব তার শেকড় থেকে ধারণ করতে হবে। তবেই আমরা বাঙালি পরিচয়ে নিজেদের তুলে ধরায় সার্থকতা মনে করবো।