প্রবাসীর স্বজনদের জীবনসংগ্রাম:টাকা আসে, মানুষ আসে না (পর্ব ৩)

সুবর্ণা হামিদ
বিদেশে রোজগারের আশায় যারা পাড়ি জমান, তারা শুধু মানুষ নন—তারা কারো সন্তান, কারো স্বামী, কারো বাবা। প্রবাসীরা টাকা পাঠান ঠিকই, কিন্তু রেখে যান একরাশ শূন্যতা।
সেই শূন্যতা নিয়ে বছরের পর বছর লড়াই করে যান দেশের বুকে পড়ে থাকা স্বজনরা।
একদিকে বিদেশের মাটিতে রোজগারের লড়াই, অন্যদিকে দেশের মাটিতে একাকীত্ব, দায়িত্ব আর প্রতীক্ষার কষ্ট। প্রবাসীর বাবা-মা—সবাই মিলে চালিয়ে যান এক কঠিন জীবনসংগ্রাম।
বৃদ্ধ মা-বাবারাও শারীরিক ও মানসিক দূরত্বে ক্ষয়ে যেতে থাকেন। টাকা পেলেও ছেলের মুখ দেখতে না পারা, উৎসবের দিনে পাশে না থাকা—এই অভাব মেটাতে পারে না কোনো ডলার কিংবা রিয়াল।
এ লড়াইয়ের নেই আলাদা স্বীকৃতি, নেই সম্মাননা। তবু তারা লড়ছেন। ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছেন।
তাদের মুখে হাসি থাকে, কিন্তু ভিতরে জমে থাকে অপেক্ষার পাহাড়।
এ বিষয়ে সিলেট নগরীর জল্লার পারের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আব্দুস সামাদ বলেল - আমার ছেলে আজ ৯ নয় বছর ধরে ফ্রান্সে আছে, টাকা ঠিকই পাঠায় কিন্তু এক বারের জন্যও আসতে পারে না,কত ঈদ যায় ছেলে থাকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারি না।
বৃদ্ধা মা রোখসানা খাতুন বলেন -আমার ছেলে বাইরে থেকে টাকা পাঠায়, কিন্তু তার মুখ দেখা আর কাছাকাছি হওয়ার বাসনা মিটে না। মৃত্যুর আগে একবার হলেও তার গলায় জড়িয়ে ধরার স্বপ্নে বেঁচে আছি আমি।
প্রবাসীর ছেলে রায়হান বলেন -আমি বাবাকে শুধু ভিডিও কলে দেখি, তার আসার অপেক্ষায় বুক ফাঁকা লাগে। ঈদের আনন্দ যখন সবাই সঙ্গে কাটায়, আমি শুধু মায়ের পাশে থেকে তার ফিরে আসার স্বপ্ন দেখি।
নগরীর লোহার পাড়ার বাসিন্দা দোকানদার শফিকুল ইসলাম বলেন-আমার ছেলে কাতারে ১২ বছর ধরে শ্রম করছে, টাকা পাঠিয়ে আমাদের সংসারের অনেক বোঝা লাঘব করেছে। তবু সে যত দূরে থাকুক না কেন, তার অভাব যেন ঘরটাই শূন্য করে দিয়েছে। প্রতিদিন দোকান থেকে ফিরে দরজার দিকে তাকাই—হয়তো একদিন হঠাৎ ফিরে আসবে।
এ ব্যাপারে প্রবাসীদের সাথে মোবাইলের মাধ্যমে কথা বললে সৌদিআরব প্রবাসী মোসাহিদ আলী বলেন -আমি পাঁচ বছর ধরে সৌদি আরবে আছি, তবে এখন আর স্বেচ্ছায় দেশে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমার এক্সামিনেশন মেয়াদ শেষ হওয়ায় অফিসিয়ালি দেশে ফিরতে পারছি না। তাই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করে পরিবারের জন্য টাকা পাঠাই। আমার বাবা-মায়ের একমাত্র অবলম্বন আমি, তাদের পাশে থাকার জন্য আমার একমাত্র মাধ্যম এই টাকা পাঠানো। তবে দেশের মাটিতে ছোঁয়া কিংবা তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য অনেক বেশি ইচ্ছে থাকলেও পরিস্থিতি সেভাবে করে দেয় না।
যুক্তরাজ্যে প্রবাসী সাকাওয়াত হোসেন বলেন-আমি ইতোমধ্যে বারো বছর ধরে লন্ডনে আছি, কিন্তু এখনও এ দেশে স্থায়ী নাগরিকত্ব পাইনি। তাই দেশে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ আমার হাতে নেই। যদি এখন দেশে যাই, তাহলে আর ফিরে আসার পথ বন্ধ হয়ে যাবে, এবং আমার সব স্বপ্ন ও অর্জন একেবারে শেষ হয়ে যাবে। এত বছর বিদেশে থেকে পরিবারের জন্য সংগ্রাম করলেও এই অনিশ্চয়তার কারণেই হৃদয়ে এক গভীর শূন্যতা বাসা বেঁধেছে। দেশে থাকা পরিবারের কথা মাথায় রেখে প্রতিদিন ভালো করার চেষ্টা করি, তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, দূরত্বের এই ফাঁকটাই আমাদের সবচেয়ে বড় কষ্ট।
আমেরিকা প্রবাসী সুমন আহমদ বলেন - আমি বৈবাহিক জীবনে নতুন করে এ দেশে এসেছি, এখন পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এতদিন পাড়ি জমিয়েও এখনও নাগরিকত্ব পাইনি। এই অনিশ্চয়তার কারণে এখন দেশে যাওয়ার কথা ভাবাটাও শুধু স্বপ্নের মতো, যা বাস্তবে সম্ভব নয়। দেশে থাকা পরিবারের কথা মাথায় রেখে আমি বার বার চেষ্টা করি, কিন্তু প্রতিবারই ফিরে আসে হতাশার ছায়া। প্রতি দিন বাড়তি কাজ করে সংসার সামলাচ্ছি, কিন্তু কখনো কখনো মনে হয়—যে দূরত্ব মেটে না, সেটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট।
এ বিষয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থাপক ও আন্তর্জাতিক টিআইপি হিরো অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত আল-আমিন নয়ন বলেন- প্রবাসীদের পাঠানো টাকা যদিও পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাদের শারীরিক ও মানসিক উপস্থিতির অভাব যে শূন্যতা তৈরি করে, তা কোনও অর্থে পূরণ সম্ভব নয়। অনেক সময় প্রবাসীর অনুপস্থিতি থেকে সৃষ্ট একাকীত্ব ও বিষণ্নতা পরিবারের বৃদ্ধ সদস্য থেকে শুরু করে শিশুদের মধ্যেও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। তাই শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, তাদের মানসিক ও সামাজিক কল্যাণের জন্য সচেতনতা ও কার্যকর সহায়তা নিশ্চিত করা এখন অতি জরুরি। আমরা চাই, সরকার ও সমাজ মিলেমিশে প্রবাসী পরিবারগুলোর যন্ত্রণা বুঝে তাদের জন্য সমগ্রিক সহায়তা ব্যবস্থা গড়ে তুলুক, যাতে তারা শুধুমাত্র অর্থিকভাবে নয়, মানবিকভাবে ও সামাজিকভাবে সুরক্ষিত বোধ করতে পারে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন-প্রবাসীরা যখন বছরের পর বছর পরিবার থেকে দূরে থাকেন, তখন শুধু সম্পর্কের উষ্ণতাই হারিয়ে যায় না, পরিবারের ভেতরে মানসিক চাপ ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতাও তৈরি হয়। বিশেষ করে সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা-মা—এরা সবচেয়ে বেশি ভোগেন। সন্তানরা বড় হয় বাবার বা মায়ের অনুপস্থিতিতে, আর বৃদ্ধরা কাটান একাকী বার্ধক্য। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্য থাকলেও এই শূন্যতা পূরণ হয় না। এ বিষয়টিকে আমরা শুধু পারিবারিক সমস্যা হিসেবে দেখলে চলবে না—এটি একটি সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সংকট, যার সমাধানে সচেতনতা, নীতি সহায়তা ও সামাজিক সমর্থন জরুরি।