অন্যরকম এক শিক্ষানুরাগী

অন্যরকম এক শিক্ষানুরাগী

  মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক  

উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে যাকে জীবিকার সন্ধানে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, পারিবারিক টানাপোরানের কারণে শিক্ষাজীবনের অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেনি। যার ওপর ছোট ভাইবোনের বিশাল দায়িত্ব কাঁধে, তার পক্ষে কতটা শিক্ষানুরাগী হওয়া সম্ভব? হ্যাঁ এমনই একটি প্রশ্নের জলজ্যান্ত উদাহরণ কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ধান্যদৌল গ্রামে জন্ম নেওয়া মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী। বর্তমানে তিনি আমেরিকা প্রবাসী। আমেরিকার অন্যান্য ট্যাক্সি-উবার চালকদেরই মাঝে তিনিও একজন। নিউইয়র্কের পথে পথেই কেটেছে তাঁর ২৯টি বছর। তিনি নিউইয়র্কে ট্যাক্সিক্যাব চালান, কখনো ফাস্টফুডের দোকানে আবার কখনো নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। উদ্দেশ্য একটাই, অর্থ উপার্জন করে পরিবার ও সমাজের জন্য কিছু একটা করা। জনহিতকর কাজে লাগাতে হবে নিজের ঘাম ঝরানো অর্জন। যার রক্ত ঝরানো ঘামে আজ গড়ে উঠেছে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
বলছিলাম জীবন সংগ্রামের নায়ক মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরীর কথা। ১৯৬৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী ও মোসাম্মাৎ আশেদা খাতুন চৌধুরী দম্পতির প্রথম সন্তান মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী। ১৯৭৪ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী মারা যান। ৬ সন্তানকে বুকে নিয়ে মায়ের সংগ্রামী পথচলা নিজ চোখে দেখেছেন মোশাররফ। চাচাদের সহায়তায় কোনো মতে দিন চলে তাদের। ১৯৮৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর কাতারে চলে যান জীবিকা নির্বাহের তাগিদে। ১৯৮৯ সালে দেশে এসে ধান্যদৌল গ্রামে বাবার নামে আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে সেখানে শিক্ষার্থীর  সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। এরপর ১৯৯৪ সালে মা ও দাদির নামে আশেদা-জোবেদা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা গড়ে তোলেন। ২০১৪ সালে বোর্ড সেরা ২০টি কলেজের তালিকায় স্থান করে নেয় কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার মোশাররফ হোসেন খান ডিগ্রি কলেজ। ১৯৯৯ সালে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা সদরে মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর সেখানে স্নাতক কোর্স চালুর দাবি ওঠে। সেই দাবি বাস্তবায়নে মনোযোগী হয় সরকার। এখন কলেজটিতে ১০টি বিষয়ে স্নাতক শিক্ষা চালু আছে। সেখানে ৩ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। একই বছর এই উপজেলা সদরে আবদুল মতিন খসরু মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। বর্তমানে সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০০-এর উপরে। ২০০২ সালে মুমু রোহান কিন্ডার গার্টেন নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০০ জন। গরিব ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানে সহায়ক হিসেবে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ২০১০ সালে কুমিল্লায় তিন নামে পরিচিত ব্রাহ্মণপাড়া ডায়াবেটিক হাসপাতাল নির্মাণে দান করেন ১ বিঘা জমি। শুধু এগুলোই না, গরিবদের সহায়তা, গৃহহীনদের ঘর করে দেওয়া এমনকি মসজিদ নির্মাণেও নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। অসাধারণ অমায়িক ব্যবহারের এই মানুষটি দান করেই তৃপ্ত।
শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখা এই মানুষটি অনুপ্রেরণার উৎস বাবা ও দাদাকে। তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করা। ১৯৩৭ সালে নিজ গ্রামে ধান্যদৌল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর বাবার দাদা মরহুম সিরাজ খান চৌধুরী। স্কুল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি নিজেও ছিলেন সেখানকার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে মোশাররফ হোসেন চৌধুরীর বাবা মরহুম আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী রাঙামাটির মতো দুর্গম এলাকায় জ্বালেন শিক্ষার আলো। সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নিজের এলাকা থেকে শিক্ষক নিয়ে গিয়ে সেখানে চাকরি দেন। গ্রামবাসীর সহায়তায় তিনি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন নিজ ভূমিতে।
শিক্ষার আলো বিলিয়ে যার তৃপ্তি, সবসময় তিনি চেয়েছেন নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কখনই যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে না চলে। অর্থ উপার্জনে বার বার ছুটে গেছেন দেশের বাইরে। তবু সবসময় মন পড়ে থেকেছে তাঁর সন্তানতুল্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। সেখানে থেকেও তদারকির অভাব রাখেননি। আর তাই তো প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই এমপিওভুক্ত হয়েছে। পেয়েছে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি আর তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় এমন একটি মহৎ উদ্দেশ্য দিন দিন সফল হয়েছে। তাঁর প্রথম উদ্দেশ্য ছিল ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছানো। কোনো রকম আর্থিক লাভের আশা না করেই নিজের সব উপার্জন ঢেলেছেন এসবের পেছনে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি হওয়ায় তিনি শুধু প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পদে আছেন। মোশাররফ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুরাগ এসেছে আমার পারিবারিক শিক্ষা থেকেই, ‘মূলত বাবার স্কুল গড়ার স্বপ্নকে আমি একে একে বাস্তবে রূপ দিয়ে চলেছি’। তিনি বিশ্বাস করেন, আমার প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজ থেকেই একদিন দেশ পরিচালনার কারিগর তৈরি হবে’।
নিজের এই পথচলায় সবচেয়ে বেশি কাছে পেয়েছেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীকে। তাঁর অনুপ্রেরণার কারণেই এত কিছু করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি চাইলেই আমার স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু সেটা করলে তো আমার স্বপ্নে ছেদ পড়ত। প্রবাসের জীবন খুবই কষ্টের। পরিবার নেই দেখেই আমি অবিরাম কাজ করতে পারি। টাকা পাঠাতে পারি দেশে।’ তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলো আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? তিনি হাস্যোজ্জ্বল মুখে সরল উত্তর দিলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা আরও কীভাবে মানসম্মত করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করা’। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলো অন্যদের মতো পারিবারিক ভোগবিলাসে জীবন না কাটিয়ে দুই হাত ভরে দান করার মূল মন্ত্র কী? সহজ সরল উত্তর, ‘সবাই দান করতে পারে না। আল্লাহ যার পক্ষে থাকেন, প্রকৃতিও তার পক্ষে থাকে। তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন বলেই আমি এতকিছু করতে সক্ষম হয়েছি’। তিনি অকপটে বলেন, জীবনের ত্যাগ স্বীকার করে সমাজের উন্নয়নে কাউকে না তো কাউকে হাল ধরতে হবে, নইলে পরবর্তী প্রজন্ম কীভাবে গড়ে উঠবে’।
মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরীর মানবসেবা করার নেশাটা ছিল পারিবারিকভাবেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে আরাম-আয়েশের জীবন কাটাতে চাননি কখনোই। তাই তো স্ত্রী-সন্তানদের দেশে রেখে প্রবাসের দূর্বিষহ জীবন পার করিছেন। তাঁর দুই ছেলেমেয়ে ঢাকাতে থেকেই পড়াশোনা করছেন। ঢাকাতে তাঁর পরিবার চালাতে বেশ খরচ হয়। সেটা জোগান দেন তিনি। চাইলেই ঢাকা শহরে ৮ থেকে ১০টি বাড়ি, দামি গাড়ির মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তা না করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খুবই সাধারণ জীবন-যাপন করেছেন। ত্যাগের মহিমায় তাদেরও অংশগ্রহণ রয়েছে সমানভাবে।
মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী শুধু শিক্ষা বিস্তারে গভীর মনোযোগী নন, পরিবেশ বান্ধব গাছ লাগাতেও খুববেশি ভালোবাসেন। এলাকার স্কুল-কলেজের আঙিনায় কয়েক হাজার গাছ লাগিয়েছেন। বিদেশের বুকে বাংলাদেশি কেউ মারা গেলে লাশ দেশে পাঠানোর বন্দ্যোবস্ত করাটাও যেন তাঁর দায়িত্ব। অসহায় ও অসুস্থ ব্যক্তিকে সাহায্য করতে পিছপা হননি কখনো। এলাকার গরিব ছেলেমেয়েদের জন্য নিজ নামে গড়ে তোলা ফাউন্ডেশন থেকে ব্যবস্থা করেছেন শিক্ষাবৃত্তির। এসব কাজে সবসময় তাকে উৎসাহ যুগিয়ে সাহায্য করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর খান চৌধুরী, দাদা জাকির খান চৌধুরী ও তাঁর সহধর্মিণী।
তাঁর যত অর্জন না বললেই নয়ঃ
♦ ২০০১ সালে এশিয়ান ডেমোক্র্যাটিক অ্যাসোসিয়েশন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড।
♦ ২০০৬ সালে ফোবানা অ্যাওয়ার্ড, জর্জিয়া আটলান্টা, আমেরিকা।
♦ কুমিল্লা সোসাইটি অ্যাওয়ার্ড, আমেরিকা জেতেন ২০০৬ সালে।
♦ সিটি হল অ্যাওয়ার্ড, নিউইয়র্ক, আমেরিকা পান ২০০৭ সালে।
♦ ২০১০ সালে জেতেন কুমিল্লা সোসাইটি স্বর্ণপদক অ্যাওয়ার্ড, আমেরিকা।
♦ অর্জনের ঝুলিতে ২০১৪ সালে যোগ হয় কুমিল্লা সোসাইটি উত্তর আমেরিকা ইনক অ্যাওয়ার্ড।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক