খোলা চিঠি

খোলা চিঠি

হেনা বেগম 

আমার পুতুল,,
কেমন আছিস্ তুই? বড্ড মনে  পড়ছে তোর কথা। জানিনা তোর কি মনে পড়ে আমাকে। তিন যুগ পার হয়ে গেল কিন্তু তোকে আজ ও আমি ভুলতে পারিনি। এখন ও ঘুমাতে গেলে তোর আলো জ্বলমল মুখখানি আমার চোখে ভাসে। প্রায়ই তোকে  স্বপ্নে দেখি। একটা বার যদি জানতে পারতাম তুই কোথায় আছিস্। কেমন আছিস্। কত গল্প জমা হয়ে আছে মনের খাতায়। কখন ও কি তা বলতে পারব। 
আমি যার কথা বলছি সে আর কেউ না সে আমার প্রথম বন্ধু আমার পুতুল খেলার সাথী। তার নাম দিলাম পুতুল। কারন সে পুতুলের মতই সুন্দর ছিল। সহজ সরল শান্ত হাসি  খুশি একটা মেয়ে। পুতুল আমার থেকে দুই তিন বছরের ছোট ছিল। স্কুলে ও সে আমার তিন ক্লাস নিছে ছিল। কিন্তু আমরা একসাথে খেলতাম। একসাথে গোসল করা পুকুরে সাঁতার কাটা, দিনের বেশীর ভাগ সময় আমরা একসাথে কাটাতাম। ও ছিল শান্ত আমি ছিলাম চন্চল। সকালে মুখ ধোয়ার উছিলায় আমরা পুকুর ঘাটে বসে ঘন্টা গল্প করতাম। ও যে কোন সুযোগ পেলেই আমাদের ঘরে চলে আসত। কখন ও আম্মাকে বলে আমাকে নিয়ে যেত তাদের ঘরে থাকার জন্য। রাত জেগে গল্প করতাম। বৃষ্টিতে ভিজে আমরা গল্প করতাম তারপর পুকুরে সাঁতার কাটতাম লাই লাই খেলতাম। ও যখন তার নানাবাড়ি যেত আম্মাকে বলে আমাকে সাথে নিয়ে যেত। আম্মা মানা করলে কান্না শুরু করত। ওর কান্না দেখলে আম্মা রাজি হয়ে যেতেন। ওর নানাবড়ি ছিল নদীর ওপারে। নৌকা দিয়ে খেয়া পার হয়ে যাওয়া খুব ভাল লাগতো। কত মজা করতাম ওর নানা বাড়িতে গিয়ে। ও খুব আদরের ছিল  ওর পরিবারের এবং ওর নানী মামার চোখের মনি ছিল। ওর ছোট চাচার তো জান ছিল ও। সে তার চাচাকে ফুতু বলে ডাকতো। 
আমরা কাপড় দিয়ে পুতুল বানিয়ে খেলতাম। পুতুলের বিয়ে দিতাম। পুতুলের বিয়ের দিন আমরা শাড়ি পরতাম চুরি করে নিয়ে যেতাম আমাদের আম্মার শাড়িগুলা। শৈশবের সেই দিনগুলি পার করে আমরা বড় হতে লাগলাম। আমি যখন ক্লাস এইটে উঠি সে ভর্তি পরীক্ষা দিল ক্লাস সিক্সের। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারায় সে আরেকটা হাই স্কুলে ভর্তি হলো। আমাদের সম্পর্কের একটু দুরত্ব হতে লাগলো। আমার পড়ালেখার চাপ বাড়তে লাগলো। খেলার দিন আমাদের শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর ও আমরা সময় পেলে দেখা করতাম। হাসি গল্পে মেতে উঠতাম। 
একদিন জানতে পারলাম ও কাউকে ভালবাসে।যাকে সে ভালবাসে সে তার স্কুল টিচার। তাকে বাড়িতে এসে  প্রাইভেট পড়াত এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো  সে ছিল  ভিন্ন ধর্মের । আমার বিশ্বাস হলোনা। মানতেই পারছিলামনা।কারন এটা কখন ও কেউ মেনে নিবেননা।  মনে হয়েছিল হয়তো সময়ের সাথে সাথে এসব থাকবেনা। কারন ওর বয়স কম। প্রেম টেম এগুলা সে তখন বুঝে ও না। ও আমাকে কিছু বলেনি। আমি ও জিজ্ঞেস করিনি। সে সুযোগ ও পাইনি।কারন আমার বিয়ে হয়ে আমি চলে যাই। নতুন জীবন, সংসার নিয়ে আমি যখন ব্যাস্ত  হঠাৎ জানলাম সে পালিয়ে গেছে ঐ মাষ্টারের সাথে।  শুধু এইটুকুই জেনেছিলাম ওর এস এস সি পরীক্ষার শেষ দিন ছিল পরীক্ষার হলে না গিয়ে পালিয়ে যায়। সেই যে যায় আর ফিরে আসে না। কোথায় যে  গেল? শুধু জেনেছিলাম লোকমুখে তাকে নাকি ইন্ডিয়া নিয়ে গেছে। তার পরিবার ঐ লোকের উপর মামলা করেন কিন্তু ওঁকে পাওয়া যায়নি। প্রচুর টাকা পয়সা খরচ করেন তার ভাই, মামা চাচা সবাই। কিন্তু ওর কোন খবর মেলেনি। 
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে ও কি সুখে আছে? কোথায় আছে? কেমন আছে?  ভালবেসে পালিয়ে গিয়ে অনেকেই বিয়ে করেছে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে। তেত্রিশ  বছর  পেরিয়ে গেছে তার খোঁজ আর পাইনি। 
ও কি সত্যি সত্যি এমন জীবন চেয়েছিল? কেন এমন করলো? ও কি বেঁচে আছে! অনেক অনেক প্রশ্ন আমার মাথায় ভীর করে যখনই ওর কথা মনে হয়। কেন জীবনটাকে এভাবে নষ্ট করলি?
যে মেয়েটির সাথে আমি লাল, নীল ফড়িং ধরেছি মাঠে প্রান্তরে দৌড়েছি। রাতে জোনাকি পোকা নিয়ে খেলা করেছি। বড়ই গাছে উঠে বড়ই পেড়ে ক্ষেতের ধনিয়া পাতা আর কাঁচা মরিচ দিয়ে ভর্তা করে মাঠে বসে খেয়েছি। ঝড় বৃষ্টির সময় আম কুড়াতে বের হতাম একসাথে, মেঘের গর্জন শুনে কৈ মাছগুলো যখন পুকুরের পারে উঠত আমরা খুশিতে চিৎকার করতাম। পাশের ঘরের চাচীর আচার চুরি করে খেতাম। সকালে মক্তবে যাওয়ার সময় তেঁতুলের বিচি নিয়ে যেতাম পড়ার ফাকে খেলা শুরু করে দিতাম। মাঝে মাঝে আড়ি দিয়ে কথা বলা বন্ধ করলে সে আম্মার কাছে এসে কান্না শুরু করতো কথা না বলে থাকতে পারতনা।  কি করে আমি ভুলব ওঁকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি তাকে আজ ও খুঁজি। 
আমি আজ ও তার সাথে মনে মনে কত কথা বলি। কত হারিয়ে যাওয়া মানুষ ও তো একবার তার জন্মভূমিতে ফিরে আসে। সে কি আসতে চায়নি? নাকি তাকে আসতে দেওয়া হয়নি! এমন হাজারো প্রশ্ন?  যার উত্তর জানা নাই কারো।  আমাদের কি আর কখনো দেখা হবেনা। সে জানবেনা আমি যে তাকে আমার বুকের ভিতরে সযত্নে রেখেছি। আমার আর তার ছোটবেলার কথা আমার বাচ্চাদের সাথে গল্প করি। জোৎস্না রাতে চাঁদের আলো দেখলে তার কথা মনে পড়ে। কত রাত আমরা উঠানে খেলা করেছি। তার কি আমার কথা মনে আছে? সে কি আমার মত আমাকে নিয়ে ভাবে? আমার ফেলে আসা দিনগুলির কথা মনে পরলেই একটা ব্যাথা অনুভব করি বুকের ভিতর। একটা শূন্যতা একটা অজানা কষ্ট  আজ ও কাঁদায়। কত রাত তার কথা ভেবে ভেবে ঘুম হয়নি। আপন মনে বলি -

বন্ধু একাই আমি জাগব
আঁধার আকাশে একা চিরদিন চেয়ে আমি থাকব
আমারে সে ভুলে গেছে সে কথা আমি তো বেশ জানি
স্মৃতির সাগর থেকে তারে তবু ডেকে আমি আনি।
মরীচিকা জানি তবু আলো ভেবে দুনয়নে রাখব।