নির্বাচনের আগে যে বার্তা দিল যুক্তরাষ্ট্র

বাংলাভাষী ডেস্কঃঃ

বাংলাদেশ সফরে এসে গণতন্ত্র-ভোট নিয়ে পুরোনো বার্তাই পুনর্ব্যক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলে। এর আগে ঢাকা সফরে আসা তার সহকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এলিট বাহিনী র‌্যাবের টেকসই সংস্কার, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান, গণতন্ত্রের উন্নতি বিষয়ে যে ধরনের কথা বলে যান তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে ডেরেকের সফরেও।

ডেরেক শোলে গত মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা সফরে আসেন। পর দিন বুধবার তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একই দিনে বৈঠক করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে। এ ছাড়া তিনি দেশের সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গেও গোলটেবিল আলোচনা করেন। এসব আলোচনা বা বৈঠকেই বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলে গণতন্ত্র ও ভোট নিয়ে কথা বলেছেন। এ দুটি ইস্যুতে এর আগে শোলের সহকর্মীরা ঢাকা সফরে এসে যে বার্তা দিয়ে গেছেন তিনিও সেটা পুনর্ব্যক্ত করে যান। শোলের এ সফরের বৈঠকগুলোতে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, যৌথ অগ্রাধিকার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানবাধিকার, জলবায়ু, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতেও আলোচনা হয়।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গণতন্ত্র নিয়ে ডেরেক শোলে এক বৈঠকে বলেন, ‘কোনো দেশে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়লে ওই দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা করার সক্ষমতা সীমিত হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে বিনিয়োগে।’ ওই বৈঠকে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়নি বাংলাদেশ। আসন্ন মার্চে দ্বিতীয় বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে গণতন্ত্র সম্মেলন হওয়ার কথা, সেখানেও বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি কেন? শোলে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর প্রথম গণতন্ত্র সম্মেলন হওয়ার পর অংশগ্রহণকারী এবং যারা যোগ দেয়নি সবাইকেই গণতন্ত্র বিষয়ে আমাদের সামগ্রিক অঙ্গীকারকে আরও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টায় অবদান রাখার অংশ হিসেবে পরের বছরের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির আহ্বান জানাই আমরা। বাংলাদেশ নিজের সিদ্ধান্তে এমন কোনো কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেনি। বাংলাদেশ ভবিষ্যতে এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেতে পারে।’
গণতন্ত্র এবং নির্বাচন নিয়ে ওই বৈঠকে শোলে বলেন, ‘মানবাধিকার ও পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কখনো তার উদ্বেগ গোপন রাখেনি এবং ভবিষ্যতেও রাখবে না। আমরা মনে করি, যেখানেই হোক না কেন, সব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হওয়া উচিত এবং এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে নির্বাচনের ফলাফল পরাজিত পক্ষও গ্রহণ করে। গণতন্ত্র একটি কঠিন বিষয় এবং আমারও এটি নিয়ে বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করছি।’
সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে যুক্তরাষ্ট্র কী করবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডেরেক বলেন, ‘সেটা আমি এই মুহূর্তে বলতে পারব না।’ আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নেবে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হবে। তবে নির্বাচন যে প্রক্রিয়ায় হোক না কেন তা অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ডেরেক শোলে মানবাধিকার ইস্যুতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং র‌্যাবের টেকসই সংস্কার প্রত্যাশা করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এ প্রসঙ্গে সময়ের আলোকে বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে আলাপ হয়েছে। আমরা বলেছি, এ আইনের যেখানে যেখানে প্রয়োজন আমরা সংশোধন করছি। র‌্যাবের প্রশিক্ষণ বিষয়ে আমরা তাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছি।’ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পক্ষে বাংলাদেশের সমর্থন প্রত্যাশা করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বলেছে, বৈশি^ক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে এ যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত এবং এ যুদ্ধ বন্ধ করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কথা হয়েছে। আমরা এ যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তাদের আহ্বান জানিয়েছি।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রশংসা করেন ডেরেক শোলে। এই ইস্যুতে সমর্থন ও সহযোগিতার দৃঢ় আশ্বাস ব্যক্ত করে এই মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে সক্রিয় সহযোগিতা ও সমর্থন অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র। অতি সম্প্রতি বার্মা অ্যাক্ট প্রণয়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যা এ সংকট সমাধানে প্রভাব ফেলবে। রোহিঙ্গা গণহত্যার অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আদালতেও সমর্থন ও সহযোগিতা করবে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সংকটের মূল সমস্যা চিহ্নিত করতে কাজ করবে। এ সংকট সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর জোট আসিয়ানের সঙ্গে কাজ করবে।’ তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের রাখাইনে বাংলাদেশ নিরাপদ অঞ্চল গড়তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানালে ডেরেক শোলে শুধু শুনেন, কিন্তু কোনো মন্তব্য করেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ের ফেলো এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আনু আনোয়ার সময়ের আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র বলেই যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ঘন ঘন ঢাকা সফর করছেন। সেই সঙ্গে তারা এ বার্তাও দিচ্ছেন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসন কোনো ছাড় দেবে না।’
সাবেক অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব এবং রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এ সফরে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে তাদের যে এজেন্ডা সেটাই তারা আবারও প্রকাশ করে গেছে এবং এ স্বার্থ রক্ষা করতেই তারা বাংলাদেশে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের মতো করেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে চায়। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। আমাদের কূটনীতিতে প্রো-অ্যাকটিভ কোনো রোল নেই। আমরা জানি না যে, তাদের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে আমাদের পজিশন কী হবে। অথচ ওরা ওদের মতো করে এগিয়ে যাচ্ছে।’
অন্যদিকে একই দিনে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কাত্রার ঢাকা সফরে গত বুধবার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক (ফরেন অফিস কনসালটেশন বৈঠক) করেন। ওই বৈঠকে দুই পক্ষ তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনাসহ বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে যেসব অনিষ্পন্ন ইস্যু রয়েছে তা দ্রুত নিষ্পত্তিতে একমত হয়। এসব ইস্যুসহ অনিষ্পন্ন ইস্যু সমাধানে বাংলাদেশ ভারতের যে সহযোগিতা চেয়েছে সেখানে দেশটির পক্ষ থেকে কেমন আশ্বাস পাওয়া গেছে এবং এর বিপরীতে ভারত কিছু চেয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বৃহস্পতিবার বলেন, ‘এফওসি বৈঠকে সম্পর্কের সব ইস্যুতে আলোচনা করেই অনিষ্পন্ন ইস্যুগুলো দ্রুত সমাধানে একমত হয় দুই পক্ষ।’