মুকুটবিহীন সম্রাট কবিয়াল রাইগোপাল (প্রবন্ধ)

মুকুটবিহীন সম্রাট কবিয়াল রাইগোপাল (প্রবন্ধ)

লিটন দাশ গুপ্ত 

১৯৮৭ সালের শেষ দিকের কথা। আমি সকালবেলায় এক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ শুনতে পেলাম, শোক সংবাদের মাইকিং করা হচ্ছিল। ঐ সময় জানতে পারি, বিশিষ্ট কবিয়াল রাইগোপাল দাশ মৃত্যুবরণ করেছেন। এলাকায় সকলের মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া। তখন পাড়ার অন্য সহপাঠী থেকে অবগত হই, শোকাহত স্যারও প্রাইভেট পড়াবেনা! তাই আর যাওয়া হলনা। বিকেলে প্রতিবেশীদের মধ্যে কথপোকথনে জানতে পারি অন্তেষ্টিক্রিয়ায় প্রচুর মানুষ উপস্থিত হয়েছে। যে কথা কর্ণগহ্বরে এখনো প্রতিধ্বনি হচ্ছে।

কবিয়াল রাইগোপাল দাশ হচ্ছেন বোয়ালখালী উপজেলাধীন আমুচিয়া ইউনিয়নের ধোরলা গ্রামের অধিবাসী। গ্রামটি আমার ইউনিয়নের অন্তর্গত এবং পার্শ্ববর্তী নিকটস্থ গ্রাম। সেই হিসাবে তাঁদের পরিবারের সাথে জানা শোনা থাকাতে কবিগান সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি এবং রাইগোপাল দাশ-কে প্রত্যক্ষভাবে চিনতে পারি। 

এমন একসময় ছিল গ্রামে গঞ্জে বিনোদন মানে যাত্রাপালা, নাটক, পালাগীত, কবিগান ইত্যাদি। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলনা। পরবর্তীতে কিছু গ্রামে ইলেকট্রিসিটি এলেও খুব কম ঘরে টেলিভিশন ছিল। সাধারণ মানুষ সাড়া বছর অপেক্ষা করে থাকত, কখন কোন জায়গায় পালাগান বা নাটক অনুষ্ঠিত হবে, সবাই দল বেঁধে এক সঙ্গে যাবে। যা আমরা আশির দশকে কৈশোরকালীন সময়েও দেখেছি। যদিও আমরা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রমেশ শীলের মত কবিয়ালের কবিগান সরাসরি মঞ্চে দেখেনি, কিন্তু প্রত্যক্ষ দর্শক থেকে অনেক কিছু জেনেছি শুনেছি। এছাড়া রমেশ শীলের কয়েকজন শিষ্যের কবিগানও দেখেছি। তাঁদের মধ্যে শৈশবে দেখা অন্যতম একজন কবিয়াল রাইগোপাল দাশ। যিনি স্থানীয়ভাবে আমাদের কাছে ‘রাইগোয়াল সরকার’ হিসাবে অধিকতর পরিচিত ছিলেন। কবিয়াল রাইগোপাল জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৮ সালে ০২ ফেব্রুয়ারি এক কৃষক পরিবারে। স্কুলের ছাত্র অবস্থা থেকে তিনি কবিগানের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং যাত্রাদলে যোগদান করেন। পরবর্তীতে যাত্রাদল ছেড়ে গৌড়িয় কীর্তন মঠে বৈষ্ণবদের কাছ থেকে কীর্তন শেখেন। এরপর করিম বক্সের কবিগান শুনে নিজেই গান লিখে সুর দিয়ে কবিগানকে পেশা হিসাবে নিয়ে কবিয়াল হবার স্বপ্ন দেখেন। দীর্ঘ সাধনার পর অবশেষে পাশ্ববর্তী ইউনিয়নের অধিবাসী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবিয়াল রমেশ শীল থেকে কবিগানে আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা নেন এবং তাঁকে গুরু হিসাবে বরণ করে কবিয়াল হবার স্বপ্ন পূরণ করেন। 

১৯৮৭ সালের অক্টোবর মাসে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত ‘কবিগান’ নামক বই হতে রাইগোপাল দাশ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানা যায়। সেখানে লেখা হয়েছে, বৃটিশ আমলে চট্টগ্রামে যুব বিদ্রোহের কারণে, গ্রামে গঞ্জে পুলিশ মিলিটারি কর্তৃক সর্বদা অত্যাচার করা হত। রাইগোপাল, কবিয়াল হিসাবে কিছুটা পুলিশের দৃষ্টির অগোচরে ছিলেন। সেই সুযোগে তিনি ১৯৩৭ সালে মুক্তি পাওয়া অসংখ্য যুববিদ্রোহীদের সংস্পর্শে এসে মার্কসবাদ দর্শনে উদ্বুদ্ধ হন। তারপর মার্কসবাদ আদর্শে রাজনীতি শুরু করেন। তখন থেকে কৃষক শ্রমিক গরীব মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হন এবং মার্কসবাদী কৃষক সমিতি বোয়ালখালী অঞ্চলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৮ সালে রমেশ শীলকে সভাপতি করে ‘রমেশ উদ্বোধন ও কবি সমিতি’ এবং পরবর্তীতে ‘চট্টগ্রাম জেলা কবিয়াল সমিতি’ নামে কবিয়ালদের সমিতি গঠিত হয়। সেখানে রাইগোপাল দাশ কার্য নির্বাহী সদস্য হন। পরবর্তীতে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে তিনি এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষের কৃষক সম্মেলনে এবং বর্ধমান জেলার বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনে রমেশ শীলের সাথে কবিগানে অংশ গ্রহন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে কবিগান পরিবেশন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। এইসময় সকল শ্রেণির মানুষ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তৎকালীন কলকাতার দৈনিক পত্রিকায় ফলাও করে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। রমেশ শীলের জীবনাবসানের পর কবিয়াল ফনি বডুয়া এবং রমেশ পুত্র যজ্ঞেশ্বর শীল এর সাথে রাইগোপাল দাশ কবি গানে অংশগ্রহন করে প্রশংসিত হয়েছিলেন।

 ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর অনেক কবিয়াল কলকাতায় চলে যান। কিন্তু সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে সেইসময় যে কয়জন কবিয়াল পাকিস্তান অংশে থেকে যান তাদের মধ্যে রাইগোপাল দাশ অন্যতম। তিনি এই দেশে থেকে গরীব দুখী মানুষের কথা কবি গানের মাধ্যমে সকলের কাছে তুলে ধরেছিলেন। ধনবাদ পুঁজিবাদ সমাজ ব্যবস্থা, কুসংস্কার সাম্প্রদায়িকতা বিরুদ্ধে কথা সুর ও কন্ঠের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার কর্তৃক ‘বাংলার কবিয়াল’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। যেটি কবি গানের মূল্যবান দলিল হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। সেখানে রমেশ শীলের জীবনীসহ কয়েক জন তাঁর শীর্ষস্থানীয় শিষ্যের গান ধারণ করা হয়। এদের মধ্যে একজন কবিয়াল রাইগোপাল।  

রাজনৈতিক আদর্শ প্রগতিশীল চিন্তা চেতনা কবিয়াল রাইগোপাল দাশকে বিভিন্ন সময় বারে বারে শাসক দলের নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছে। ১৯৫৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। তখনো তিনি ছদ্মবেশে নিজের নাম গোপন করে বিভিন্ন জায়গায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কবিগান পরিবেশন করেছেন। বিভিন্ন সময় পুলিশ বাড়িতে তাঁকে না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের উপর নির্যাতন করেছে। ভিন্ন মতাদর্শের কারণে বাড়িতে একাধিক বার প্রতিপক্ষ কর্তৃক অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তবুও নিজ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। সমাজসংস্কারক, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও একসময়ে ‘দুরদর্শন’ এ ব্যাপক জনপ্রিয় এই কবিয়াল ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

একসময় শহরের আনাচে কানাচে কিংবা গ্রামগঞ্জের বিনোদন ছিল কবিগান, যা আগেই বলেছি। তবে এখনকার প্রজন্মের অনেকেই জানেনা কবিগান কি! এই কবিগান হচ্ছে বাংলার প্রাচীন লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা। এই ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহন করে থাকে। এখানে গায়ককে উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন কবি হতে হয়; তাঁকে যে কোন বিষয়ে তাৎক্ষনিক পদ রচনা করে সুরারোপ করে গান গাওয়ার দক্ষতা ও ক্ষমতা থাকতে হয়। কবিগানে কোন একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে দুই দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। যিনি দলের নেতা তাঁকে ‘কবিয়াল’ বা ‘সরকার’ বলা হয়ে থাকে। আর দলে অন্য সহযোগী সদস্য যারা বিভিন্ন বাদ্য বাজিয়ে ও সমস্বরে সহযোগিতা করে, তাঁদের ‘দোহার’ বলা হয়ে থাকে। তিন দশক আগেও চট্টগ্রামে বিষ্ণুপদ আর রঞ্জিতকর এর পাল্টাগান বিখ্যাত ছিল। তখনো কিন্তু বেশ আবেদন ছিল কবিগানের। সময়ের পরিবর্তনে এখনকার অনেক মানুষ, যদিও সংসার ভাঙ্গা আর অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে নেতিবাচক কল্পকাহিনীর গল্প নাটক দেখতে, জি-বাংলা আর স্টার জলসায় প্রবেশ করেছে, তখন কিন্তু কবিগান বা যাত্রাগানই ছিল শ্রেষ্ঠ বিনোদন। আর এই কবিগান বা পাল্টাগান ছিল জ্ঞানভিত্তিক তর্কবির্তক বা এক ধরণের বাকযুদ্ধ; যেখানে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত, সমাজের অসংগতি, আধ্যাত্বিক তত্ত্ব ইত্যাদি ছিল উপজীব্য। 

যাই হোক, সবশেষে কবিয়াল রাইগোপাল দাশের সাত সন্তানের কনিষ্ঠ ছেলে সুমন দাশ’র আক্ষেপের কথা বলে শেষ করতে চাই। তিনি বলেন, বিশ্ব বরেণ্য কবিয়াল রমেশ শীলের প্রধান দুই শিষ্য ফনী বড়ুয়া এবং রাইগোপাল দাশ। ১৯৬৭ সালে কবিয়াল রমেশ শীল এক ভরা পূর্ণিমায় কর্ণফুলী নদীর তীরে নিশি ভ্রমণে বের হলে, শিষ্য রাইগোপাল দাশকে শ্লেষ্মাজড়িত কন্ঠে বলেছিলেন, তাঁর (রমেশ শীল) সময় শেষ হয়েছে। সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এর কিছু দিন পরই নাকি কবিয়াল রমেশ শীল মৃত্যুবরণ করেন। এমন আন্তরিক সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যের। তিনি আরো বলেন, রমেশ শীলের শিষ্য কবিয়াল ফনী বড়ুয়া একুশে পদকে ভুষিত হয়েছেন। রমেশ শীলের ঢোল বাদক বিনয়বাঁশী জলদাসও একুশে পদকে ভুষিত হয়েছেন। কিন্তু রমেশ শীলের শিষ্য রাইগোপাল দাশকে কোন প্রকার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি। একইসাথে আমরাও বলতে চাই, বাংলার লোকসাহিত্যের অন্যতম ধারক বাহক, কবিয়াল রাইগোপাল দাশকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে স্বীকৃতি দিয়ে কবিগানকে পুনরায় উজ্জীবিত করা হোক।