“ক্যাম্পাস থেকে জাতীয় মঞ্চে: ছাত্র রাজনীতি উত্থান কি বদলে দেবে জাতীয় রাজনীতির ধারা?”

“ক্যাম্পাস থেকে জাতীয় মঞ্চে: ছাত্র রাজনীতি উত্থান কি বদলে দেবে জাতীয় রাজনীতির ধারা?”

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রভাব বরাবরই গভীর। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির প্রধান শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তবে সাম্প্রতিক নতুন করে আলোচনায় এসেছে ইসলামী ছাত্রশিবির—যে সংগঠনটি দীর্ঘদিন প্রান্তিক অবস্থানে থাকলেও এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে একচেটিয়া বিজয়ের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ক্যাম্পাস থেকে জাতীয় মঞ্চে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাম্প্রতিক উত্থান দেশের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং এটি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ধারাকে প্রভাবিত করতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এই উত্থানের বাস্তব চিত্র এবং সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হলো:

ক্যাম্পাসের পরিবর্তিত চিত্র:

বিগত এক দশক ধরে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রশিবিরের পুনরুত্থান অনেককে বিস্মিত করেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক ক্যাম্পাসে সংগঠনটির সাংগঠনিক সক্রিয়তা ও নির্বাচনী সাফল্য তাদের পুনরায় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ভিত্তিক রাজনীতির প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি এবং প্রচলিত দলগুলোর প্রতি হতাশাই শিবিরের উত্থানের মূল কারণ।

জাতীয় রাজনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব:

বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ছাত্র সংসদে শিবিরের প্যানেলের বিজয়" – এটি একটি অত্যন্ত দূরগামী এবং রূপান্তরকারী (Transformative) রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্ম দেবে। 
বাংলাদেশে ইতিহাস বলছে, ক্যাম্পাসের রাজনীতি অনেক সময় জাতীয় রাজনীতির রূপরেখা নির্ধারণ করে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতন, ছাত্র আন্দোলনই পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
সেই প্রেক্ষাপটে, যদি ছাত্রশিবিরের এ উত্থান টেকসই হয়, তবে জাতীয় রাজনীতিতে ইসলামী রাজনীতির প্রভাব বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও তরুণ ভোটারদের মধ্যে নতুন মূল্যবোধের রাজনৈতিক আকর্ষণ তৈরি হতে পারে, যা দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের আধিপত্যে নতুন সমীকরণ আনবে।

২০২৪ সালের আগস্টে ফ্র্যসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘদিন প্রান্তিক ও নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত ইসলামী আন্দোলন জামায়াতে ইসলামী আজ নতুন এক শক্তি হিসেবে জাতীয় পরিসরে আবির্ভূত হয়েছে। বহু বছরের সংগঠনিক অভিজ্ঞতা, শৃঙ্খলাবদ্ধ কাঠামো ও বিস্তৃত কর্মীবাহিনী এখন জামায়াতকে পুনরায় রাষ্ট্রীয় প্রভাববলয়ে নিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে তারা দেশের প্রধান প্রধান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।

বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদদের মতামত:
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নাসির উদ্দিনের মতে,
“ছাত্রশিবিরের সাম্প্রতিক সাফল্য কেবল একটি সংগঠনের নয়, বরং বাংলাদেশের তরুণ সমাজে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের প্রতিফলন। তরুণরা এখন বিকল্প খুঁজছে।”

কারো কারো মতে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে জামায়াত ছিল অন্যতম কঠোর দমন-পীড়নের শিকার রাজনৈতিক দল। দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই— যেমন গোলাম আজম, মতিুর রহমান নিজামী, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান— ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আদালতের রায়ে ফাঁসিতে ঝুলেন বা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ বিচারপ্রক্রিয়াকে গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে আখ্যা দিয়েছেন।

এই সময়কালে শত শত নেতাকর্মী কারাগারে বন্দি হন, অনেকেই গুম বা হত্যার শিকার হন। ২০১৩ সালে নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে, এবং ২০২৫ সালের ১ আগস্ট— শেখ হাসিনা ভারত পালানোর মাত্র চার দিন আগে— দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা আজ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। কারণ, শেখ হাসিনার পতনের পর জামায়াত আবারও জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে ফিরে এসেছে—একটি নতুন বাস্তবতা ও নতুন জোট রাজনীতির যুগে।

অন্যদিকে আওয়ামী ও বিএনপি ঘরানার রাজনীতিকরা একে ‘অস্থায়ী উত্থান’ বলেই দেখছেন। তাদের মতে, শিবিরের সংগঠনভিত্তিক সাফল্য এখনো জাতীয় নির্বাচনী বাস্তবতায় অনূদিত হয়নি।

সমালোচনা ও বিতর্ক:
ছাত্রশিবিরের উত্থানের সঙ্গে বিতর্কও জড়িত। অতীতে সংগঠনটির বিরুদ্ধে সহিংসতা, চরমপন্থার অভিযোগ এবং নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কের ইঙ্গিত বহুবার এসেছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংগঠনটি নিজেদের ‘গঠনমূলক ইসলামী আন্দোলন’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে, তবু সমাজের একাংশ এখনো তাদের কর্মকাণ্ডকে সন্দেহের চোখে দেখে।

তরুণদের মনস্তত্ত্ব ও সামাজিক প্রেক্ষাপট:
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ, জাতীয় পরিচয় ও নৈতিক রাজনীতির প্রশ্নে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে। অনেকেই মনে করছেন, প্রচলিত দলগুলোর দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সহিংস রাজনীতি তরুণদের বিকল্প ভাবনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই ফাঁকেই ছাত্রশিবির নতুন করে জায়গা তৈরি করছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে বছরের পর বছর নিষেধাজ্ঞা, গ্রেফতার ও দমন-পীড়নের পরও জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির আবারও বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে ফিরে এসেছে—এটি তাদের সাংগঠনিক স্থায়িত্ব ও শৃঙ্খলার প্রতিফলন।
শিবিরের বিজয় প্রমাণ করে, তারা তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষার্থী সমাজে পুনরায় গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করছে।
প্রশাসনিক দমন সত্ত্বেও সংগঠনের কাঠামো ও নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ অব্যাহত ছিল—এ বিজয় তার ফল।

জাতীয় রাজনীতিতে বার্তা
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাংলাদেশের রাজনীতির পরীক্ষাগার বলা হয়।

তাই শিবিরের ধারাবাহিক বিজয়কে অনেক বিশ্লেষক জামায়াতে ইসলামী’র সম্ভাব্য পুনরুত্থানের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।

এটি মূলত দেখাচ্ছে যে, জামায়াতের রাজনীতি এখনো মৃত নয়; বরং নতুন নেতৃত্ব ও কৌশলে তারা আবার মূলধারায় ফেরার চেষ্টা করছে।

পাশাপাশি, ইসলামী রাজনীতির প্রতি সমাজের একাংশের আগ্রহও নতুন করে জেগে উঠছে।

সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি:
এটি কেবল ক্যাম্পাসভিত্তিক পুনর্জাগরণ; জাতীয় পর্যায়ে এখনো জামায়াতের রাজনৈতিক পুনরায় গ্রহণযোগ্যতা অর্জন কঠিন।
তরুণদের মধ্যে প্রভাব থাকলেও, পুরনো যুদ্ধাপরাধ ইস্যু এবং আন্তর্জাতিক চাপ জামায়াতের পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক পুনরাবির্ভাবকে এখনো বাধাগ্রস্ত করছে।

ছাত্রশিবিরের সাম্প্রতিক উত্থান নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটি সাময়িক উচ্ছ্বাস না স্থায়ী পরিবর্তনের সূচনা—তা সময়ই বলে দেবে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন নতুন ধারা ও আদর্শের রাজনীতি দেখতে চায়, এবং ক্যাম্পাস রাজনীতিই হতে পারে সেই পরিবর্তনের সূতিকাগার।

ক্যাম্পাস থেকে জাতীয় মঞ্চে ছাত্রশিবিরের সাম্প্রতিক সাফল্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। এটি শুধু ছাত্র রাজনীতিকেই প্রভাবিত করছে না, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ধারায় ইসলামপন্থী রাজনীতির শক্তি, কৌশল ও ভবিষ্যতের প্রভাব নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই উত্থান দেশের রাজনীতিতে মেরুকরণ, নতুন জোট গঠন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বৃহত্তর গ্রহণ যোগ্যতার মতো পরিবর্তন এনে দিতে পারে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

মিসবাহ উদ্দিন আহমদ 
নিউওয়ার্ক, যুক্তরাষ্ট্র।