চা বাগানে শিক্ষা ব্যাবস্থা অগ্রযাত্রা : অভাবকে জয় করে শিক্ষায় উজ্জ্বল চা শ্রমিকের সন্তানরা পর্ব ৫

চা বাগানে শিক্ষা ব্যাবস্থা অগ্রযাত্রা : অভাবকে জয় করে শিক্ষায় উজ্জ্বল চা শ্রমিকের সন্তানরা পর্ব ৫

সুবর্ণা হামিদ

অভাব, অনিশ্চয়তা, আর নানান সীমাবদ্ধতা—এই সবকিছুকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সিলেট অঞ্চলের চা বাগান এলাকার শিশুরা। এই শিশুরা শুধু চা শ্রমিক পরিবারের সন্তান নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু—তারা এখন আশার প্রতীক, আগামী দিনের সম্ভাবনা।

দীর্ঘদিন ধরেই চা শ্রমিক পরিবারগুলো দেশের সবচেয়ে প্রান্তিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীগুলোর একটি। কিন্তু সেই বাস্তবতা ভেদ করেই আজ এগিয়ে আসছে নতুন এক প্রজন্ম। তারা বই-খাতা নিয়ে হাঁটে স্বপ্নের পেছনে। শিখছে, জিতছে, দেখাচ্ছে—চাইলেই পারা যায়।

সাম্প্রতিক এসএসসি পরীক্ষায় মালনীছড়া চা বাগানের শিক্ষার্থী সুস্মিতা দাস অর্জন করেছে জিপিএ-৫। তার সাফল্য এখন পুরো এলাকার অনুপ্রেরণা।

সুস্মিতার বাবা গোবিন্দ দাস মানসিক প্রতিবন্ধী, মা তারামনি দাস বাগানে দৈনিক মাত্র ১৭৮ টাকা মজুরিতে কাজ করেন। পাঁচজনের পরিবার, সীমাহীন সংকট, কিন্তু তার চোখে আজও একটাই স্বপ্ন—উচ্চশিক্ষা।

সুস্মিতা জানায়, “অনেকদিন ধরেই ইচ্ছা, বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। কিন্তু বাস্তবতা বড় কঠিন। টাকার অভাবে শঙ্কায় থাকি। তবুও বিশ্বাস আছে—কেউ পাশে থাকলে আমি পারবো।”

সুস্মিতার মতোই আরেক সাহসী কন্যা তৃষা বাউরী। জাফলংয়ের চা বাগান এলাকার এই মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় পেয়েছে এ+। এখন সে মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

পরিবারে অভাব, কিন্তু তার মনোবল দুর্বল হয়নি। সে জানে, একদিন সে হয়ে উঠবে অসুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর এক নাম—একজন ডাক্তার।

অন্যদিকে, মালনীছড়ার আরেক মেধাবী ছাত্র রাজু নায়েক বর্তমানে সরকারি কলেজে অনার্সে পড়ছেন। পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধেই।

দিনে দিন টিউশন করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালান তিনি। রাজুর স্বপ্ন? একজন শিক্ষক হওয়া—শিক্ষা দিয়ে সমাজ বদলে দেওয়া।

প্রত্যাশা সমাজ কল্যাণ যুব সংঘের সভাপতি সাইদুল ইসলাম সোহেল বলেন, “চা বাগানের শিশু-কিশোররা নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও লেখাপড়ায় এগিয়ে যাচ্ছে—এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। আমরা চেষ্টা করছি, যেন কেউ আর্থিক কারণে ঝরে না পড়ে। সরকার ও বেসরকারি সংস্থার যৌথ উদ্যোগ আরও জোরদার হওয়া উচিত।”

এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো)-এর নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেন, “শুধু বৃত্তি নয়, দরকার সামাজিক সমর্থন। এই ছেলেমেয়েগুলো ভীষণ মেধাবী ও পরিশ্রমী। সময়মতো সহায়তা পেলে তারা দেশের অন্যতম সম্পদে পরিণত হবে। শিক্ষা হচ্ছে ক্ষমতায়নের মূল চাবিকাঠি—এটাই প্রজন্ম বদলের পথ।” 

তিনি আরও বলেন, “আমরা এমন একটি ভবিষ্যৎ গড়তে কাজ করছি যেখানে প্রতিটি শিশু তার স্বপ্নপূরণের সুযোগ পাবে। এর জন্য দরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকার, উন্নয়ন সংস্থা ও স্থানীয় কমিউনিটির একসাথে কাজ।”

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা IDEA-এর ECETG প্রকল্প সমন্বয়কারী সুদীপ্ত চৌধুরী বলেন, “আমরা দেখেছি—সঠিক দিকনির্দেশনা, পুষ্টি, শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ এবং মনোযোগী অভিভাবকত্ব থাকলে চা শ্রমিক পরিবারের শিশুরাও অসাধারণ ফলাফল করতে পারে। তারা পিছিয়ে নেই, শুধু সুযোগ পাচ্ছে না।”

তিনি আরও বলেন, “অনেক সময় একজন শিক্ষক, একজন মেন্টরই যথেষ্ট হয় জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে। তাই এখন দরকার সমন্বিত উদ্যোগ—যেখানে সবাই একযোগে কাজ করবে।”

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ কাওছার আহমদ বলেন, “সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকার বলা হলেও চা শ্রমিক পরিবারের শিশুরা অনেকক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে। এ বাস্তবতায় আমাদের দায়িত্ব তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে শক্ত ভিত্তি গড়ে দেওয়া। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় যেন তারা পিছিয়ে না পড়ে—এটাই হওয়া উচিত রাষ্ট্রের অঙ্গীকার।”

এই গল্পগুলো কেবল কিছু শিশুর নয়—এগুলো একটি লড়াকু প্রজন্মের প্রতিচ্ছবি, যারা প্রতিদিন প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা বোঝাচ্ছে, সমাজের প্রান্তিক কোনও শিশুও উপযুক্ত সুযোগ পেলে হয়ে উঠতে পারে তার সময়ের নায়ক।

এই অগ্রযাত্রা যেন থেমে না যায়, বরং আরও বেগ পায়—সেজন্য এখনই সময় আমাদের, সমাজের, রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেওয়ার। এই শিশুদের স্বপ্ন যেন বাস্তব হয়—আমরা সবাই যেন তাদের পাশে দাঁড়াই।

সরকারি নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদ নেওয়াজ বলেন—

আমি অনেক দিন ধরে শিক্ষকতা করছি। চা শ্রমিক পরিবারের শিশুদের শিক্ষা নিতে কী কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা আমি কাছ থেকে দেখেছি। অনেক সময় না খেয়ে স্কুলে যায়, বই নেই, আলো নেই, তবুও শেখার আগ্রহে কোনো ঘাটতি নেই। আমরা দেখেছি—যারা একটু সহায়তা পেয়েছে, তারা দুর্দান্ত ফলাফল করেছে। কেউ কলেজে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, কেউবা ভালো চাকরিও করছে।

এই শিশুরা প্রমাণ করেছে—সুযোগ পেলে তারাও পারে। এখন দরকার তাদের জন্য একটি টেকসই ও সমন্বিত সহায়তা কাঠামো গড়ে তোলা, যাতে প্রতিভা হারিয়ে না যায় শুধু দারিদ্র্যের কারণে।

চা বাগানের এই সব শিশু-কিশোররা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে—প্রতিবন্ধকতা যত বড়ই হোক, স্বপ্ন বড় হলে কিছুই আটকাতে পারে না। এই গল্পগুলো শুধু সাফল্যের উদাহরণ নয়, বরং পুরো সমাজের সামনে এক নিরব প্রশ্নচিহ্ন—আমরা কি যথেষ্ট করছি?

তাদের অগ্রযাত্রা যেন থেমে না যায়, পিছিয়ে না পড়ে কেউ শুধুমাত্র জন্মপরিচয়ের কারণে। দরকার দায়িত্বশীলতা, দরকার সহযোগিতা—সরকারি ও বেসরকারি, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সবার পক্ষ থেকে। কারণ প্রতিটি শিশুর উন্নতি মানেই একটি জাতির সম্ভাবনার জাগরণ।

আজ যারা বাগানের ধুলোবালি মাড়িয়ে স্কুলে যায়, তারাই একদিন নেতৃত্ব দেবে এই দেশকে—এই বিশ্বাসই হোক আমাদের অঙ্গীকার।