কবি তাহমিনা চৌধুরীর (মিতালি) কবিতার কাব্য বিশ্লেষণ।
মোহাম্মদ আলী।
কারো ছন্দোবদ্ধ সৃষ্টি যদি শ্রুতিমধুর বা হৃদয়ঙ্গমতা হয় তবে, এই অবচেতন মন পাঠ্যসুখে অলঙ্কারবদ্ধ হয়েই যায়।
প্রকৃতি আমাদের বন্ধু, প্রাণের বন্ধু, প্রকৃতি বাঁচলে প্রাণের স্পন্দন হয়, আর প্রকৃতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে জীব ও ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়।
”তাহারে চক্ষে দেখি নাই, দেখিয়াছি তার চিত্র, ডাকিয়াছি হেমাঙ্গিনী। কাব্যের সৌন্দর্য, রূপময়তা অন্তরে বিঁধেছে কাঁটা, কাহারে কহিবো আমি সেই প্রকৃতি, যাহার উচ্ছ্বাস শুধুই একটুসখানি হাসি”—
প্রকৃতি প্রেমীদের অন্যতম একটা পছন্দের স্থান হলো সবুজ মাঠ, সবুজে ঘের ছায়া সুনিবিড় একটি স্থান। যেই মাঠ যদিও বিরাণভূমি, কিন্তু সেইখানে থাকল প্রকৃতির মেলবন্ধন। আর তার ডাকে সাড়া দিয়ে সেই মাঠের পাশেই জেগে উঠে শান্তির তরুছায়া।
তেমনি প্রকৃতির সাথে মিতালি নিয়ে লেখা একটি কবিতা পড়ে আসি। কবির কবিতা পড়ে সেই মাঠে, সেই সবুজবীথির সাথে হাওয়ার মিতালি কি ভাবে হলো জেনে নেই।
সবুজ পাতায় হাওয়ার মিতালি
মাধুর্যের নেই শেষ,
ডাল গুলো কেমন শূণ্যে দোলে
মনোরম পরিবেশ।
আসুন প্রথম চার লাইনের আলোচনা করি—
যদিও খুব সাদামাটা কথা গুলো। কিন্তু বিষয় বস্তু হলো সে কথা কি আপনার আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে ।
যদি করে থাকে, তবেই ভালো লেখা এবং গণমানুষের তথা প্রকৃতির কবি বলে বিবেচিত হবেন। যদি স্পৃহা না জাগে, অন্তর না ছোঁয় তবে ধরে নেবো আমার পাঠে ত্রুটি রয়েছে।
আমরা কি কখনো স্বচক্ষে হাওয়ার সাথে পাতার মিতালি দেখিনি। অবশ্যই দেখেছি। একটু অনুধাবন করুন তো—
বাতাস এলেই তো পাতা নড়ে। আরও লক্ষ্য করুন সেই বৃক্ষের ছায়ায় কোনো সে পথিক যে স্বস্তির নিঃশ্বাস অথবা তার আনন্দের স্বাদ টুকু অনুমেয় হলো না?
যদি হয়, তবে আপনি ও এই কবিতার স্বাদ পেলেও পেতে পারেন। সাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন। কবির এই লেখা পরিবেশের সাথে মানুষের আত্মাকে নিবিড় পর্যবেক্ষনে নিবন্ধিত করতে পেরেছেন বলে আমার বিবেচিত হয়েছে, যা আপনার ও হবে।
দ্বিতীয় চার লাইনে কি বললেন, পড়ে দেখি—
ভূমির সাথে সূর্য্যের মিতালি
কেবল বিলায় আলো, ,
সজিবতা লোফে বৃক্ষ লতা
প্রাণীকুল থাকে ভালো।
সূর্যের কিরণ যখন মাঠে ছড়ায়, সেখানে বৃক্ষ তরুলতা প্রাণ ফিরে পায়। আমরা জানি যেখানে সূর্যের আলো পড়ে না, সেখানে লতাপাতা ও জন্মায় না।
এখানে বলাবাহুল্য মিতালি বলতে কি বুঝিয়েছেন।
আমি যা ধারণা করছি, তা হলো সহনীয় পর্যায়ের তাপমাত্রা। "মিতালি" তো বন্ধুরাই করে, সহনশীল তো বন্ধু হয়। অর্থাৎ সহনশীল তাপমাত্রা।
নতুবা মরুভূমিতে সূর্যের তাপমাত্রা অতি মাত্রার জন্য সবকিছু পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। তাহলে সে তাপে মিতালি হলো না। অর্থাৎ সেই মিতালী অসহনীয়। তাই মরুদ্দানে বৃক্ষ তরুলতা প্রাণকে নিষ্প্রাণ করে তুলে। সেই তাপমাত্রা মিতালী সম নয়, বিধায় স্নিগ্ধ কোমলতা পায় না।
সেই সাথে---
সহনশীল তাপমাত্রা সকলেই লোফে নিতে আগ্রহী হয়। যথার্থই বলেছেন মিতালি অনুধাবনে এখানে প্রাণিকুল ভালো থাকে। মিতালি মননে শুদ্ধতা প্রকাশ পায়।
তৃতীয় চার লাইনে কি পেলাম —
রাতের সাথে চাঁদের মিতালি
স্বপ্নচারিনীর বুকে,
লক্ষ তারার মিটিমিটি হাসি
স্নিগ্ধ কোমল সুখে।
রাতের সাথে চাঁদের মিতালি। এখানে প্রেমের গন্ধ পাওয়া যায়। যেহেতু স্বপনচারিনী আছে। সে প্রেম তরুলতার মধ্যে ও হয়, আবার মানুষের মধ্যে ও হয়।
যেখানে স্বপ্ন আছে সেখানে তার চারিণী আছে, আছে বাঁচার প্রার্থনা। জন্ম জন্মান্তরের বাসনা। আছে লক্ষ তারার অনাগত ভবিষ্যতের সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট। আছে স্নিগ্ধ কোমলতার গল্প, আছে সুখের ঘ্রাণ। আছে সুষমা সৌন্দর্যর রূপ লাবণ্য।
জ্ঞান গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে সূক্ষ্ম রচনাবোধ তার ভাবনাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী সুখ।
এবং শেষ চার পংক্তিতে কি আছে—
আকাশের সাথে জলের মিতালি
শিল্পীর আঁকা ছবি,
ছন্দের সাথে গানের মিলন
লিখেন যেনো কবি।
আকাশের সাথে জলের মিতালি। আবারও মিতালির কথা চলে এলো, অর্থাৎ শুরু এবং শেষের কথা।
আমাদের এই পৃথিবীর আকাশ এবং জলের সরাসরি মেলবন্ধন নেই। কিন্তু আধ্যাতিক অর্থে মিতালি অর্থে, তা ওতোপ্রোতো ভাবেই জড়িত।
এই পৃথিবীতে যাহা সৃষ্টি হয়, প্রকারান্তে তাহাই লিপিবদ্ধ আছে এবং চিরকাল থাকবে। ইতিপূর্বে হাজার হাজার শিল্পী ছবি এঁকেছেন এবং অদূরভবিষ্যতে ও লক্ষ লক্ষ শিল্পী ছবি এঁকেই যাবেন।
এখানে মনের সাথে ইতিহাসের পাতায় যে মিতালি তা চির অম্লান হয়ে থাকবে।
পরিশেষে ছন্দের সাথে গানের কথায় সমাপ্তি টানলেন।
সঙ্গীত এমন একটি বিষয়, যেখানে যুগে যুগে মানুষের মুখে মুখে দ্রুত ছড়িয়ে যায়। হৃদয়ে গেঁথে থাকে আজন্মকাল অবধি। সময়ের সাথে নিত্য খেলা করে আপন ভুবনে। হয়ে উঠতে ভুবনমোহিনী।
কবির কবিতা যেমন তরুলতা থেকে আকাশের কথা আছে, তেমনি আছে জলের কথা, আছে মিটিমিটি তারার কথা।
স্নিগ্ধ কোমলতার কথা। লক্ষ প্রাণের সুখের স্বপ্নের কথা, মিতালি থেকে মিলনের কথা। অমিয় ধারায় ছান্দোগ্য ছন্দের কথা। আছে প্রকৃতির সাথে, পরিবেশের সাথে মহা প্রেমের কথা।
শুভেচ্ছা অহর্নিশ।
-------মোহাম্মদ আলী।