আমারও একটা ভেলা আছে

আমারও একটা ভেলা আছে


আফতাব চৌধুরী

মাঝে মাঝে একটা স্বপ্ন দেখি। দেখি আমার পরীক্ষা, কিন্তু যে বিষয়ে পরীক্ষা দেব তার মূল্য বই আমার কাছে নেই। আমি কিনিনি, অথবা হারিয়ে গেছে। স্বপ্নের আলো-অন্ধকার আবছায়ায় কিছু বন্ধুর মুখ ভাসে, যাদের কাছে আমি ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইছি কোন রুমে পরীক্ষা চলছে। কেননা রুম নাম্বার আমার জানা নেই। অবশেষে রুম খুঁজে পেলেও কলম থাকে না পকেটে। এ রকম নিদারুণ অসহায় অবস্থায় পড়ে যখন আমার ঘুম ভাঙ্গে তখন প্রাথমিক ধকল সামলে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। অতঃপর মনে গহীন থেকে বেরিয়ে আসে একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস। সেই সময়টাতে সবচেয়ে ভালো লাগে এই ভেবে যে, আদতে আমার কোনো পরীক্ষা চলছে না।

স্বপ্ন দেখি একটা ছোট্ট নদী। সেই নদীর জাগ্রত অবস্থায়ও সর্বক্ষণ আমার মস্তিষ্কের কোষে বিচরণ করে। শান্ত, স্থির, চঞ্চল নদী। হালকা বাতাসে কাকচক্ষু পানি একটু কেঁপে উঠলে নদী পাড়ের সবুজ গাছপালা সেই পানির ভিতর দোল খায়। অনেকটা কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রিয় নদী ধলাইয়ের মত। বেশ কয়েক বছর আগে নদী নিয়ে তাঁর কোনো এক লেখায় ধলাই নদীর ছবি দেখেছিলাম। সেই রচনায় কবি তাঁর প্রিয় কংস নদের কথাও লিখেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পড়ার পর তিতাস আমার প্রাণের নদী হয়ে উঠে। তেমনি জীবনান্দ দানের ধানসিঁড়ি।  চমৎকার নামের এই নদী দুটিকে দু‘চোখ ভরে দেখার প্রবল সাধ জাগে। চিত্রা, মধুমতি, কপোতাক্ষ, গড়াই এমন অনেক অদেখা নদী দেখার বাসনায় আমার মন ব্যাকুল হয়। তাই আমি স্বপ্নে নদী দেখি, জাগরণে মানসপটে নদীর ছবি আঁকি।  তারা কখনো শান্ত, কখনো চঞ্চল, স্রোতস্বিনী নদীরা চরম বিপদাপন্ন আর শ্রীহীন হয়ে উঠলেও আমার মানসসঙ্গী নদীরা বরাবরই রূপসী। আমি আমার মনের মত করে তাদের সাজিয়ে নিতে পারি। আমার কল্পনার নদী গ্রীষ্মের  খরতাপের কিছুটা ক্ষীণকায়, বর্ষায় ভরা পানি স্রোতস্বিনী, শরতে নদীর জল আকাশের নীল আর কাশফুলের শ্রভ্রতা, শীতকালে নদীর উপর কুয়াশার চাদর। কুয়াশা আর নদীর পানি একাকার হয়ে যাওয়া। চোখের সামনে তখন কিছুই নেই, শূণ্যতা ছাড়া।

আমার স্বপ্ন আর কল্পনা পরস্পর বন্ধু। ওরা চলে হাত ধরাধরি করে। দুয়ে মিলে একসাথে কখনো কখনো আমার ভাবনাকে প্রভাবিত করে। ফ্রানংস কাফকার লেখা একটি গল্প পড়েছিলাম। গল্পের নাম ‘মেটামরফোসিস’। একটা ফ্যান্টাসি, অর্থাৎ বাস্তববিরোধী কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণধর্মী গল্প। কাহিনিটি এ রকম : মূল চরিত্র গ্রেগর সামসা জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত এক যুবক। একদিন ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখার পর ভোরবেলা আবিষ্কার করে সে বিরাট এক আরশোলায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই অবাস্তব পটভূমিতেই কাফকার কাহিনী এগিয়ে চলে বাস্তববাদী অনুপুঙ্খ বর্ণনার ভিতর দিয়ে। গল্পটা আমার আর পড়া হয়ে উঠে না। আরশোলা প্রাণীটিকে বাস্তবে আমি ভীষণ অপছন্দ করি। বইটি পড়তে গেলেই আমার পেটের ভিতর গুলিয়ে উঠে কিন্তু গল্প পাঠ না করলেও গ্রেগর সামসা আমার চিন্তার মধ্যে ঢুকে পড়ে। আমার রাগ হয়। মনে হয়, কাফকা কেন গ্রেগরকে আরশোলায় রূপান্তরিত করলেন। গল্পের সার সংক্ষেপ পড়ে জানতে পারি, রূপান্তরিত গ্রেগরের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে কাহিনির সমাপ্তি ঘটে।

স্বপ্ন আর কল্পনার মধ্যে একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে মৃত্যু ভাবনা। কম বেশি সব মানুষ জীবনের বিভিন্ন পর্বে এই ভাবনায় তাড়িত হন। যেকোনা সময়ই এই ভাবনা প্রবল হয়ে দেখা দিতে পারে। মৃত্যু জীবনের অনিবার্য পরিণতি। জীবনের সাথে সাথে সমান্তরালভাবে মৃত্যুও এগিয়ে চলে। এই অমোঘ সত্য অস্বীকার করার সাধ্য কারুর নেই। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে জীবন একেবারেই ক্ষণস্থায়ী এটা যখন ভাবি তখন চারপাশ থেকে এক অদ্ভুৎ শূন্যতা গ্রাস করে, কোন অতলে তলিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সেই অতল থেকে উঠে আসা কঠিন। ‘সত্য যে বড় কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’- এই বোধ মানুষকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে হয়তো। প্রিয়জন হারানোর বেদনার মত কঠিন বেদনা নিয়েও বেঁচে থাকতে হয়। জীবন বয়ে চলে জীবনের মত করে, তার তো থেমে থাকার অবসর নেই। মৃত্যুই জীবনকে ছুটি দেয়। মানুষ জানে সময় গড়ালেই চলে যেতে হয়, অসময়েও অনেকেই চলে যায়। কিন্তু সবার চলে যাওয়া আমরা মেনে নিতে পারি না। পরিণত বয়সে আপনজনের মৃত্যু হলে অনেকে সান্তনা দেয়। কিন্তু যে হারায় একমাত্র সেই বোঝে চিরতরে হারিয়ে ফেলার বেদনা। এই বেদনার পথটি ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। যেন এর কোনো শেষ নেই।

পৃথিবীতে যাঁরা নানা ক্ষেত্রে স্বমহিমায় বিখ্যাত হয়েছেন তাঁদের মৃত্যু হলেও তারা অমর। যুগ যুগ ধরে মহামানবরা শরীর বা অস্তিত্ব দিয়ে নয়, সৃষ্টির মধ্যেই বেঁচে আছেন। নজরুল সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে দুঃখ, বেদনা আর মৃত্যু। নিজ পরিবারের মানুষদের একে একে চলে যাওয়া বহুবার কবিকে কাঁদিয়েছে, বেদনায় ভাসিয়েছে। কিন্তু তাঁর কলম স্তব্দ হয়নি। মৃত্যুকে ধ্রুব জেনে এবং মেনে তিনি নিজেকে সঞ্জীবিত রাখার প্রয়াসী ছিলেন।

সক্রেটিস- জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক। তাঁকে বলা হয় জ্ঞানের ভান্ডার। নিজের দর্শনচিন্তা প্রচারের জন্য গ্রিসের স্বার্থান্বেষী অভিজাত শ্রেণির লোকেরা তাঁর ঘোর বিরোধী হয়ে দেশের নাগরিক আদালতে অভিযোগ আনে। আদালত তাঁকে বিষ পান করিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের নির্দেশ দেয়। মৃত্যুর আগের দিন সক্রেটিসের শিষ্য ও বন্ধুরা খুব কান্নাকাটি করছিল। সক্রেটিস স্মিত হেসে বলেন, তোমরা কাঁদছ কেনো ? আমি তো আজ মারা যাচ্ছি না, আগামী কাল, হাতে এখনো সময় আছে। পরদিন, সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় এলে সক্রেটিস ভীষণ ব্যস্ত হয়ে বিষপাত্র চাইলেন। জল্লাদ তাঁর হাতে হেমলকের পাত্র দিল। তিনি হাসিমুখে সেই পাত্র তুলে নিলেন এবং শেষবারের মতো সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে সবটুকু বিষ পান করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব মেঘ হয়ে গেল। কিন্তু না, মৃত্যুতেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। সক্রেটিসের নশ্বর দেহের মৃত্যু হলেও চিন্তা আর দমনের এক নতুন দ্বার তিনি উন্মোচন করে গেছেন। এই চিন্তাধারার মৃত্যু নেই।

পৃথিবী নামের আলোকিত এই মঞ্চে আমাদের আবির্ভাব হয় এক গহীন অন্ধকার ​থেকে। এরপর কত স্বপ্ন, কল্পনা, আনন্দ, বেদনার ভেলায় চড়ে অনন্তলোকের পথে যাত্রা শুরু হয়। ভেলা ভাসতে থাকে, ভেসেই চলে। তার গন্তব্য সেই অনন্তলোক। ভেলা কাউকে আগে পৌঁছে দেয়, কাউকে পরে। যারা আগে চলে যায় পৃথিবীর মানুষের সাথে তাদের আর দেখা হয় না। প্রত্যেক মানুষের একটা করে ভেলা আছে। আমারও আছে। তাতে ভেসে চলেছি স্বপ্ন, কল্পনা আর মৃত্যুর এক অদ্ভুত দোলাচলে। জানি, এ ভেলা যেকোনো সময় অনন্তলোকে পৌঁছে যাবে।

সাংবাদিক-কলামিস্ট।