‌কেন দেওয়া‌নের পুল আকর্ষ‌ণের কেন্দ্র‌বিন্দু ?

বাংলাভাষী ডেস্ক :

বাংলাদেশের সিলেটের গোলাপগঞ্জে একটি মুঘল আমলের তৈরি সেতু ভেঙ্গে ফেলা নিয়ে গত কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছে।

সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষীপাশা ইউনিয়নে একটি সড়কের মাঝে এই সেতুটি অবস্থিত। ওই সড়কটির নামও দেওয়ানের সড়ক।

সেতুটি পুরনো হয়ে যাওয়ায় সেটি ভেঙ্গে নতুন সেতু তৈরির বরাদ্দ দিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বা এলজিইডি।

কিন্তু পরিবেশবাদীরা বলছেন, প্রায় ৩০০ বছরের বেশি পুরনো এই সেতুটি ভেঙ্গে ফেলা হলে এই এলাকার একটি ঐতিহ্য হা‌রি‌য়ে যা‌বে।

বাংলাদেশের প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’পরিদর্শনে দেখা গেছে, প্রাচীন যে সেতুটি আছে, তার নির্মাণ শৈলি এবং শৈল্পিক রীতিতে বোঝা যায় যে, এটি একটি মুঘল যুগে নির্মিত সেতু।

"স্থানীয় ইতিহাসের কিছু রেফারেন্সে রয়েছে যে, মোঘল আমলে একজন দেওয়ান এই সেতুটি তৈরি করেছিলেন। তাই  স্থানীয়ভাবে এটি দেওয়ানের পুল বলে আখ্যায়িত হয়। ‘’

সিলেট এলাকায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের পর থেকে জেলাটি ছোট ছোট কয়েকজন আফগান শাসক এক সাথে মিলে শাসন করতেন।

ষোলশ বারো সালে আফগান শাসক বায়েজিদ কররানিকে পরাস্ত করে মুঘল জেনারেল শেখ কামাল একে মুঘল রাজত্বের আওতায় নিয়ে আসেন। 

দুর্গম হওয়ার কারণে সিলেট এলাকাকে মুঘলদের ফৌজদারি বা সামরিক জেলা হিসাবে গণ্য করা হতো।  অর্থাৎ সামরিক অধিকর্তারা এসব এলাকা শাসন করতেন।

দি রেভিনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ সিলেট ডিস্ট্রিক বইয়ে গবেষক খুশা হারাকসিং উল্লেখ করেছেন, প্রথম দিকে দুর্গম হওয়ার কারণে সিলেট জেলাকে মুঘলরা ততোটা গুরুত্ব দেয়নি। জেলাটিকে হাতি সংগ্রহের একটি স্থান হিসাবে দেখা হতো।

তবে মুর্শিদ কুলী খানের শাসনের সময় বেঙ্গলের তিনটি চাকলা বা সাব-ডিভিশনের অংশ হিসাবে সিলেটকে গণ্য করা হয়। সেই সময় ফৌজদার শাসকদের অধীনে সিলেট জেলা শাসন করা হতো। সেই সময় রাজস্ব আদায়ে যে কর্মকর্তা কাজ করতেন, তাদের বলা হতো দেওয়ান।

সিলেটের সেভ দি হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট সমন্বয়ক আব্দুল হাই আল হাদী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''শুধু মুখে মুখে নয়, সিলেটের পুরনো কাগজপত্র বা রেকর্ডে এটার উল্লেখ রয়েছে। মুঘল আমলে ১৭৪০ সালে এই সড়ক আর সেতুটি তৈরি হয়েছিল।''

''গোলাপগঞ্জের এই সড়ক এবং সেতুটি যে মুঘল আমলের তৈরি হয়েছিল, সেসব রেকর্ডপত্র সব আছে। সরকারি তথ্য বাতায়নেরও এর উল্লেখ পাবেন।''

গোলাপগঞ্জ উপজেলার সরকারি তথ্য বাতায়নে জনশ্রুতি ও কিংবদন্তির ওপর ভিত্তি করে কিছু ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে, মুঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহ এর রাজত্ব কালে ১৭৪০ সালে সিলেটের দেওয়ান বা রাজস্ব কর্মকর্তা হয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে আসেন গোলাব রাম (কেউ কেউ গোলাপ রায়ও বলে থাকেন)।

সেই সময় সিলেট অঞ্চলের ফৌজদার ছিলেন শমসের খান। সারা বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন সুজা উদ্দিন খান।

দেওয়ান গোলাব রাম একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন।

দায়িত্ব নেয়ার পরে তিনি জানতে পারেন যে, গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণে শ্রী চৈতন্যের পিতার বাড়ি ছিল। তখন তার নির্দেশে সিলেট থেকে দক্ষিণে সড়ক ও সেতু নির্মাণ করা হয়। সেই সড়ক পথে তিনি ঢাকাদক্ষিণ এসে শ্রী চৈতন্যের পিতৃভূমিতে একটি মন্দির স্থাপন করেন এবং দীঘি খনন করান।

সিলেটের গোলাপগঞ্জের হেতিমগঞ্জ থেকে ঢাকাদক্ষিণ পর্যন্ত যাওয়া সড়কটি এখনো দেওয়ান সড়ক নামে পরিচিত। সেই সড়কের এক স্থানেই একটি কালভার্ট তৈরি করা হয়। সেটি কালভার্টটি দেওয়ানের পুল নামে পরিচিতি পায়।

প্রাচীন রেকর্ডপত্রের বরাত দিয়ে সিলেটের সরকারি ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই দেওয়ানের নামানুসারে সুরমা নদীর তীর গোলাবগঞ্জ বাজারটি গড়ে উঠেছে বলে ধারণা করা হয়, যা পরবর্তীতে গোলাপগঞ্জ নাম পেয়েছে। প্রাচীন কাগজপত্রে গোলাবগঞ্জ নামটি পাওয়া যায়।

আব্দুল হাই আল হাদী বলছেন, ''সমস্যা হল, আমাদের প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর এতোটা দুর্বল, দুই-তিনটা বিভাগ নিয়ে তাদের একটা দপ্তর, সেখানেও লোকবল সংকট আছে।''

''সিলেটে (প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের) তালিকাভুক্ত পুরাকীর্তি রয়েছে মাত্র ৫০টা। কিন্তু এখানে তো আরও অনেক ঐতিহ্য আর পুরাকীর্তি রয়েছে। সেগুলো কারও কোন হিসাবে নেই। যখন এগুলো ভাঙ্গার চেষ্টা করা হয়, যখন আলোচনায় আসে, আমাদের চোখে পড়ে, তখন আমার সেটা সুরক্ষার জন্য চেষ্টা করি।''

তিনি বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশেই এরকম প্রাচীন সেতু বা স্থাপনা রক্ষা করে উন্নয়ন কাজ করা হয়। তারাও এখন সেটার জন্যই দাবি তুলেছেন।

-বি‌বি‌সি বাংলা