পাসপোর্ট–ভিসার জটিলতায় বন্দি হিজড়াদের বিদেশ যাত্রা পর্ব ১

পাসপোর্ট–ভিসার জটিলতায় বন্দি হিজড়াদের বিদেশ যাত্রা পর্ব ১

সুবর্ণা হামিদ-

সিলেটের মানুষ জীবিকার তাগিদে যুগ যুগ ধরে বিদেশমুখী। প্রবাস জীবনের মাধ্যমে তারা যেমন নিজের ভাগ্য বদলাচ্ছেন, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কিন্তু এই যাত্রাপথ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত সিলেটের তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী।

কাগজে-কলমে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও বাস্তব জীবনে তারা এখনো প্রান্তিকতার ঘেরাটোপে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই রয়েছে বৈষম্য। আর বিষয়টি যখন আন্তর্জাতিক ভ্রমণ বা প্রবাস জীবনের মতো বড় স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, তখন সেই বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে।

বিদেশ যেতে হলে প্রয়োজন পাসপোর্ট ও ভিসা। কিন্তু এখানেই দেখা দেয় সবচেয়ে বড় বাধা। পাসপোর্টে লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে তৈরি হয় বিভ্রান্তি। কোথাও তারা পুরুষ বা নারী পরিচয়ে আটকে যান, আবার কোথাও হিজড়া পরিচয়ের আলাদা স্বীকৃতিই নেই। ফলে আন্তর্জাতিক ভ্রমণে পড়তে হয় নানা ধরনের হয়রানি, অনিশ্চয়তা ও আইনি জটিলতায়।

এর জন্য সিলেটের তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী চাইলেও প্রবাস জীবনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিদেশে গিয়ে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার যে স্বপ্ন সিলেটের তরুণ-তরুণীরা লালন করেন, সেই স্বপ্ন তাদের জন্য প্রায় অধরাই রয়ে গেছে। অথচ তারাও চায় অন্যদের মতো নিজের ভাগ্য গড়তে এবং সমাজ ও অর্থনীতিতে অবদান রাখতে।

এ বিষয়ে সিলেটের হিজড়া জনগোষ্ঠীর সাথে কথা বললে আকাশ হিজড়া ক্ষোভ ও হতাশার সুরে বলেন—

আমার ভোটার আইডিতে কোথাও হিজড়া পরিচয় উল্লেখ নেই। সেখানে আমি পুরুষ হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছি। সেই সময় আলাদা পরিচয়ে নিবন্ধন করার কোনো সুযোগই ছিল না। পরে আমি যখন পাসপোর্ট করি, তখনো আমাকে পুরুষ পরিচয়ে পাসপোর্ট নিতে হয়েছে। কিন্তু এখন আমি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি চাইলে সেটা পরিবর্তন করতে পারছি না। এ কারণে আমি বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখলেও সেটা পূরণ করতে পারছি না।

তিনি আরও বলেন -আমরা নিজেরা যেমন সমাজে অবহেলিত, তেমনি রাষ্ট্রীয় নথিপত্রেও ঠিকমতো পরিচয় পাচ্ছি না। এখন পাসপোর্টে যদি ‘পুরুষ’ পরিচয় নিয়ে বিদেশ যাই, তখন বিদেশে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হবে। আবার এখানে পরিচয় পরিবর্তন করতে গেলেও আইনগত ও প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে যাচ্ছি। এই দোলাচল আমাদের জীবনে এক অদৃশ্য কারাগারের মতো কাজ করছে।

আকাশের কণ্ঠে তখন জমে ওঠে অভিমান—সিলেটের সাধারণ মানুষরা যখন প্রবাসে গিয়ে ভালো উপার্জন করে পরিবারের হাল ধরে, তখন আমরাও ভাবি—আমাদের কেন সেই সুযোগ থাকবে না? আমরা কি শুধু তৃতীয় লিঙ্গ বলেই বঞ্চিত হবো? আমরা চাই, সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নিয়ম থাকুক। যেন আমাদেরও পাসপোর্ট পাওয়া সহজ হয় এবং আমরাও বিদেশে গিয়ে নিজের ভাগ্য গড়তে পারি।

রবিউল ইসলাম সাজু বলেন-আমি লেখাপড়া করছি এবং বর্তমানে বিএসএস শেষ করছি। ছোটবেলা থেকেই বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করার স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু আমার জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্টে পুরুষ লেখা থাকায় সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারছি না। পরিচয়ের এই অসঙ্গতি আমাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আগামীতে কিভাবে এগোব, কোন পথে বিদেশে পড়াশোনা করব—এগুলো নিয়েও আমি বিভ্রান্ত এবং চিন্তিত।

তিনি আরও বলেন -আমার মতো অনেক হিজড়া শিক্ষার্থীই একই সমস্যার মুখোমুখি। আমরা স্বপ্ন দেখি, কঠোর পরিশ্রম করি, কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা আমাদের পথ বাধা দেয়। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান হলে আমরা আমাদের শিক্ষা ও প্রফেশনাল লক্ষ্য অর্জন করতে পারব এবং সমাজে অবদান রাখতে পারব।

রূপা হিজড়া বলেন-আমরা যখন পাসপোর্ট করতে যাই, কর্মকর্তারা আমাদের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকান। তারা নানা প্রশ্ন করেন—আপনার আসল পরিচয় কী? আগে পুরুষ ছিলেন, এখন হিজড়া কেন? এসব প্রশ্ন আমাদের অচেনা মনে করায়।

কাগজপত্রে কোথাও পুরুষ, কোথাও নারী, আবার কোথাও হিজড়া—এই অসঙ্গতির কারণে আমাদের আবেদন বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। অনেক সময় সঠিক নথি দিয়েও আমরা পাসপোর্ট হাতে পাই না।

এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে বারবার অপমানিত হই। সাধারণ মানুষ সহজেই পাসপোর্ট করে ফেলতে পারে, অথচ আমরা একই কাজ করতে গিয়েও পরিচয়ের কারণে হোঁচট খাই। তখন মনে হয়, আমরা এই রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও যেন অচেনা, যেন কোথাও আমাদের স্থান নেই। বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি বটে, কিন্তু সেই স্বপ্ন কেবল কাগজের ফাইলে বন্দি হয়ে থাকে।

এই বিষয়ে আশার আলো, সিলেট শাখার সভাপতি মাহফুজ আলম বলেন -আমি চারটি দেশ ভ্রমণ করেছি। বিদেশ যাত্রার আগে পাসপোর্ট প্রক্রিয়ায় কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম, কিন্তু পরে উর্ধতন কর্মকর্তারা আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়েছেন। এটি প্রমাণ করে, সঠিক দিকনির্দেশনা এবং সহযোগিতা থাকলে সমস্যা সহজেই সমাধান করা সম্ভব। অনেক হিজড়া নাগরিক আইন ও প্রক্রিয়ার সঠিক তথ্য না থাকার কারণে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সমস্যার সম্মুখীন হন।

তিনি আরও বলেন- আমাদের উচিত হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সচেতন করা, যাতে তারা আইনি নীতি, পাসপোর্ট–ভিসা প্রক্রিয়া ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সম্পর্কে আগেই জানে। একই সঙ্গে প্রশাসনও যেন তাদের সহজ ও সহায়ক পরিবেশে সেবা দিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এই ধরনের সমন্বয় থাকলে তাদের বিদেশ ভ্রমণের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।”

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, সিলেট বিভাগের প্রধান এডভোকেট সৈয়দা শিরীন আক্তার বলেন-সিলেটের হিজড়া জনগোষ্ঠীর বিদেশ ভ্রমণে সবচেয়ে বড় সমস্যা তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে (NID) লিঙ্গ পরিচয়ের অসঙ্গতি। প্রথমেই তাদের NID সঠিকভাবে সংশোধন করতে হবে, এরপরই পাসপোর্টের প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব। এই প্রক্রিয়া সহজ নয়। তারা বারবার প্রশাসনিক বাধা, জটিলতা এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হন। স্বপ্ন পূরণের জন্য তাদেরকে এক ধাপ এক ধাপ ধৈর্য ধরে এগোতে হবে, যেন নিজের অধিকার ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সুযোগ উভয়ই ঠিকভাবে নিশ্চিত করা যায়।

তিনি আরও বলেন -এটি শুধু আইনি বিষয় নয়, মানবিক ও সামাজিক বিষয়ও। হিজড়া জনগোষ্ঠী দেশের নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার রাখে, কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতার কারণে তারা প্রায়ই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সর