গ্রহণ (পর্ব ১০)

গ্রহণ (পর্ব ১০)

শামীমা আহমেদ

দীপিকা তার বাবার মৃত্যুর খবরে দেশে ফিরে নিজেদের ব্যবসায়িক চাপ, মায়ের একাকীত্ব, দীপনের পড়াশুনায় ভবিষ্যৎ গড়া নিয়ে নিজেকে দায়িত্ব আর ব্যস্ততায় ডুবিয়ে রাখল। দীপনকে দেশের পড়াশুনা শেষ করিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানোর যাবতীয় গোছগাছ করে দীপিকা মাত্রই থিতু হতে না হতেই মা দীপিকার দুশ্চিন্তায় স্ট্রোক করেন। দীপিকার ডিভোর্সটি মা কিছুতেই সহজভাবে নিতে পারেনি। এত তড়িঘড়ি করে বিয়ে দেয়াটা যে ভুল ছিল সেটা বুঝতে পেরেই এই অনুশোচনা।দীপিকা একটু একটু করে নিজেদের অফিস, ব্যবসা, শিপমেন্ট, ওয়ার্কার মেইনটেনেন্সে, সাংসারিক দেখভালে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।যদিও পারিবারিক সব দিক দেখার জনে একজন ম্যানেজার নিয়োগ দেয়া আছে। দীপিকা তার বিয়ের ব্যাপারে তার বাবার সিদ্ধান্তটি ছাড়া আর কোন কিছুতেই তার বাবার কোন ভুল খুঁজে পায়না বরং একজন মানুষ কিভাবে এতগুলো লোকের কর্মসংস্থান করেছেন তার মানে এতগুলো পরিবারের বেঁচে থাকার অবলম্বন করে দিয়েছেন সেটা ভেবে দীপিকা বারবার কৃতজ্ঞতায় বাবার প্রতি আনত হয়।

একদিন কেমন করে যেন তার ঠিকানা খুঁজে পেতে বের করে দীপিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী অঞ্জন দীপিকার অফিসে এসে হাজির। দীপিকার অনুমতি সাপেক্ষে বেশ কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বেস্টনী পেরিয়ে দীপিকার কাছে তার আগমন একটা কাজ পাইয়ে দিতে।।

অঞ্জন বহুদিন হলো বেকার জীবন যাপন করছে। এবার দীপিকা কিছু বাৎলে দিলে তার একটা গতি হয়। দীপিকা অবাক হলো! এত বছর তা প্রায় পাঁচ বছরতো হবেই, আর দেশে ওদের গ্রাজুয়েশন তো আরো আগেই হয়েছে! যা অবাক করে এত বছর পরেও তার সহপাঠী বেকার জীবন যাপন করছে? নিশ্চয়ই বউ বাচ্চা নিয়ে কষ্টে আছে।নয়তো সহপাঠীর কাছে চাকরী চাইতে আসা?দীপিকা বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে নিলো। নিজেদের এত বড় গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজে খুব সহজেই অঞ্জনের চাকুরীটা হয়ে গেলো!

সহপাঠীর সাথে এখন মালিক আর এমপ্লয়ি সম্পর্ক হলেও মাঝে মাঝে তা ছাপিয়ে বন্ধুত্বটাও যায়গা করে নেয়। সেভাবেই

একদিন অঞ্জনের সাথে কথা প্রসঙ্গে শাহেদের কথা এলো। দীপিকা অঞ্জনের কাছে শাহেদের সব খোঁজ খবর জানতে পারলো। শাহেদ বেশ একটা ভাল চাকুরী পেয়ে বিয়ে থা করে একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তানের বাবা এখন! দীপিকা পাশাপাশি নিজের জীবনটা ভাবতে থাকে। শুধু শাহেদকে ভেবেই তার সংসার করা হলো না। এতে অবশ্য শাহেদের কোন দোষ নেই। শাহেদ জানে দীপিকা বিয়ে করে লন্ডনে সুখী জীবন যাপন করছে! শাহেদ কেমন আছে দীপিকার খুব জানতে ইচ্ছে হলো।সে অঞ্জনের কাছে শাহেদের ফোন নম্বরটা চেয়ে নিলো। কোন এক অবসরে কথা বলবে

দীপিকার আজ একটু কাজের অবসর মিলল। অবশ্য এটা বলা যায় যে, ভেতরের কোন এক চাপা কৌতুহল বা উত্তেজনায় দীপিকা নিজেই যেন কাজ গুটিয়ে নিল। ইন্টারকমে প্রাইভেট এসিস্ট্যান্ট মেয়েটিকে জানিয়ে দিলো এখন যেন কোন ফোন বা কোন ভিসিটরকে এলাউ না করে। দীপিকা এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখলো বারোটা বিশ বাজছে। একটু পরেই লাঞ্চ ব্রেক। দীপিকা শাহেদের ফোন নম্বরটি টাচ করলো। ওপ্রান্ত থেকে ফোন রিসিভ হলো। দীপিকার সারা শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে যাওয়া অনুভুতি হলো। উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে অতীত বর্তমান সব মিলে মিশে কেমন যেন এক নস্টালজিক অনুভুতি। শাহেদ ফোনে জানতে চাইল কে বলছেন, দীপিকার নিজের নামটি নিজে উচ্চারণ করতে গিয়ে বিশাল এক বাধা যেন অতিক্রম করলো। নিমেষে চোখ দুটো জলে ভরলো।

দীপিকা চাপা কন্ঠে বললো, আমি দীপিকা।

ওপ্রান্তে শাহেদের উৎসাহী কন্ঠস্বরে বেরিয়ে এলো, দীপিকা তুমি কেমন আছো? কবে দেশে ফিরলে?

দীপিকা ছোট্ট করে বললো,এইতো!

শাহেদের সে কি উচ্ছ্বলতা,

তোমার সংসারের সব খবর আজ জানাবে। সেই যে তুমি চলে গেলে আর যোগাযোগ রাখলে না। একটিবার আর আমার খোঁজ নিলে না।

হঠাৎ শাহেদ বুঝতে পারলো ওপ্রান্তের নীরবতা।

শাহেদও নিজেকে থামিয়ে দিল।

এবার দীপিকা নিজেকে স্বাভাবিকে আনল। জানতে চাইল শাহেদ তুমি কেমন আছো?

শাহেদ দীপিকার প্রতি সব অভিযোগ, অনুভুতি আড়াল করে জানালো, খুব ভাল আছি। লাবনী আর ছেলে শায়ানকে নিয়ে জীবন খুব সুন্দর কেটে যাচ্ছে।

লাবনী? কে, সেই তোমার মামাতো বোনটি?

শাহেদের কাছ থেকে কখনো হয়তো জেনেছিল ওর কথা।

শাহেদ জানালো, না সে নয়,লাবনীর সাথে পরিচয় অন্যভাবে হয়েছে। সে অনেক কথা। তবে লাবনী খুব ভাল একটা মেয়ে।মায়ের মৃত্যু আর বোনদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর একাকীত্বের জীবনে লাবনী আমাকে পূর্ণতা দিয়েছে।সে আমার জীবনটাকে অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে দিয়েছে।

দীপিকা এক ঝলক ভেবে নিলো, তাহলে আমার জীবনটা এমন অগোছালো হলো কেন? সে কথা আর বলা হলো না।

দীপিকা জানতা চাইল, তোমার বোনদুটো কেমন আছে?

শাহেদ বলেই চলেছে, বোন দুটোরও আলহামদুলিল্লাহ ভাল বিয়ে দিয়েছি। ওরা নিজেরাও জব করছে। স্বামী সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই আছে। আমি মামাও হয়েছি।

দীপিকা বলল, বাহ! সবাইকে নিয়ে তবে তো তুমি বেশ ভালই আছো।এটাইতো তোমার স্বাভাবিক জীবন আর এটাই তো হওয়া উচিত ছিল। কি জানি আমার সাথে জড়ালে হয়তো তোমার জীবনটা আজ অন্য রকম হয়ে যেতো।

শাহেদ অনুযোগ করে বললো, সে আর হতে দিলে কই? আমায় একা ফেলে সুন্দর জীবন গড়ে নিলে।

দীপিকা বুঝে নিলো, শাহেদ একটা ভুল জেনে আজও দীপিকার প্রতি অভিমান করে আছে। কিন্তু শাহেদেরও যে হাত পা বাঁধা ছিল। মধ্যবিত্ত ঘরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলের জীবনের বিলাসিতা মানায় না।

দীপিকা চোখ বন্ধ করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শাহেদকে ভাবছে। নিশ্চয়ই এখন বয়সে অন্যরকম হয়েছে। শাহেদ তখন দেখতে কেমন ছিল সেটা খুব করে মেলাতে চাইছে। দীপিকার শাহেদকে দেখতে

করে মেলাতে চাইছে। দীপিকার শাহেদকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল।

ও প্রান্তে শাহেদ বলেই চলেছে, দীপিকা তোমার কথা বলো।তোমার বিদেশ লাইফ জানতে চাই।

দীপিকা বললো, সব বলবো আর দেখাও করবো এবং আজই।

শাহেদ বললো, তাই? কখন? বলো কাজ গুছিয়ে নেই।

দীপিকা বললো আজ পাঁচটায় তোমার অফিসে আমি আসবো।

শাহেদ বেশ অবাক হলো, আমার অফিস কি তোমার জানা? আমিতো সেভাবে আর তোমাকে কিছু জানাতেই পারিনি।

দীপিকা নিজের ভেতর নিজেই বলে উঠলো, তোমার কিছুই জানানোর প্রয়োজন নেই শাহেদ। আমি নিজেই সব জেনে নিয়েছি।

শাহেদ বললো, তবে তো লাবনীকে একটু জানিয়ে রাখতে হবে আজ ফিরতে দেরি হতে পারে। ও আমার জন্য খুব অপেক্ষায় থাকে।

দীপিকা কথাগুলোয় যেমন শাহেদের সুখী জীবনে তৃপ্ত হলো আবার নিজের অপ্রাপ্তির হিসেবে লাবনীর প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠল।

-----তবে কথা রইল, আমি পাঁচটায় আসছি। তুমি কাজ গুছিয়ে ফ্রি থেকো।

শাহেদ ভাবলো, নিয়াজ ভাইয়ার কাছ থেকে ছুটিটা আদায় করতে হবে।

নিয়াজ ভাইয়া শাহেদের ইমিডিয়েট বস। খুবই মাই ডিয়ার মানুষ। ভীষণ ভোজনরসিক। দেখতে গোলগাপ্পা! কোথায় কোন নতুন রেস্টুরেন্ট ওপেন হলো সেই খবরে তার কথার ঝুড়ি ভরপুর থাকে। আর তারপর চলে শুধু ট্রিট দেয়া। অফিসের এমন কেউ নেই যে তার ট্রীটের খপ্পরে পড়েনি। বিশাল ধনীর সন্তান। চাকরীটা নস্যি। আসলে জন্মগতভাবে ধনীদের জীবনটাই অন্যরকম। তারা জীবনের সব স্বাদই গ্রহণ করতে পারে। মধ্যবিত্তদের যেখানে চিরকাল শ্যাম রাখিনা কুল রাখি দশা! যাদের নুন আনতা পান্তা ফুরায় সিচুয়েছন সেখানে আজকাল ট্রীট দেয়া এক নতুন উৎপাত। জীবনের আজকের এই স্বচ্ছলতায় পৌছুতে শাহেদের কম কষ্ট করতে হয়নি।

মামার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী না হওয়ায় টাকার যোগান বন্ধ হয়ে যায়।অনেক কষ্ট করে পার্ট টাইম জব করে শাহেদকে এমবিএটা করতে হয়েছে। অনেক লোন করে বোন দুটোর বিয়ে দিতে হয়েছে।আর সব দায়িত্ব কমিয়ে দিয়ে মাও খুব দ্রুতই পরপারে চলে গেলো। বৃদ্ধ বয়েসে ছেলেকে কাছে না পাওয়ার ভয়ে দীপিকার ব্যাপারে

যে মা মত দিলেন না অথচ আজ ছেলের কাছে থাকার ভাগ্য তার হলো না।

দীপিকার ফোনের পর আজ অতীতের অনেককিছু মনের ভেতরে দাপাদাপি। মানুষের মন আর মস্তিক দুটি ভিন্ন সত্তা তা না হলে মনের এত ভাবনাও অফিসের কাজের কোন ঘাটতি হচ্ছে না। শাহেদ বিকেল পাঁচটায় ছুটি নেয়ার জন্য নিয়াজ ভাইয়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ফিরে এসে লাবনীকে ফোনে জানাতে হবে।