গ্রহণ ( পর্ব ৯)

গ্রহণ  ( পর্ব ৯)

শামীমা আহমেদ 

দীপিকার গত রাতে বেশ ঘুম হলো। খুব ভোরে ঘুম ভাঙল।চারিদিকে আযানের ধ্বনি! দীপিকা ফজরের নামাজটা আদায় করে নিলো। বাবার মৃত্যুর পর দেশে ফিরে দীপিকা নামাজে বেশ নিয়মিত হয়ে উঠে। এরপর মায়ের অসুস্থতা ওকে মানসিকভাবে ভীষণ দূর্বল করে দেয়। নামাজ পড়া, গান শোনা আর কবিতা লেখা সব মিলিয়ে ওর মনে বেশ প্রশান্তি এনে দেয়। আর একটা বিষয় দীপিকার একসময় খুব ভাল লাগতো তা হলো প্রকৃতি দেখা। দীপিকার বাবা বেঁচে থাকতে দেশে, দেশের বাইরে বহু যায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। দীপিকার পছন্দের কথা জেনে বাবা তাই বেছে বেছে সুন্দর সুন্দর প্রকৃতির যায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতো। সুইজারল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার, ভূটান, কাশ্মীর,অস্ট্রেলিয়া, আর নায়াগ্রা ফলস দেখিয়েছে কানাডা আর আমেরিকার দুদিক থেকেই। 

এমনি দেশের বাইরে আরো অনেক যায়গায় নিয়ে গেছে। তখন দীপন বেশ ছোট। মা সারাক্ষণ ওর দৌড়াদৌড়ির সাথে থাকত। আর বাবা মেয়ে প্রকৃতির মাঝে ডুবে থাকতো।দীপিকার মা বরাবরই কষ্ট সহিষ্ণু। 

যেমন তার নিজের বাবার বাড়িতে হার্ডশিপ গেছে স্বামীর সংসারে এসেও অভাব আর দুঃখকে সঙ্গী করে নিয়েছিল। আর দীপিকার 

মায়ের প্রতি বাবার ছিল প্রচন্ড কৃতজ্ঞতা বোধ। এজন্যই প্রানান্তকর চেষ্টায়, মাকে সুখী করতে দিনরাত পরিশ্রম করে একসময় তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন।

পৃথিবীর সব বাবাদের কাছে তাদের মেয়েরা

যেন স্বর্গকন্যা। কোন পাপ পঙ্কিলতা তাদের গায়ে যেন না লাগে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা।যেন অভাব ছাড়া নির্বিঘ্নে তাদের জীবন কাটাতে পারে সব বাবাদের সে চেস্টাই থাকে আজীবন।

দীপিকা ওর বাবার চোখে লক্ষী একটা মেয়ে।

তার যত বন্ধুবান্ধব আসতেন সবাইকে বলতেন আমার দীপিকা মামণির মত মেয়েই হয় না। এত নিয়ম কানুনে কঠোর একজন পিতা মেয়ের ক্ষেত্রে কেমন যেন নরম কাদার মত হয়ে যায়। 

দীপিকা অফিসে যাওয়ার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে গাড়িতে উঠল। আজ বাবার স্মৃতি তাকে ভীষণ ভাবে পেয়ে বসেছে। আনমনা হয়ে শুধু ভেবেই চলেছে। এই ভালবাসাপূর্ণ হৃদয়ের বাবাটিকে দীপিকা কষ্ট দিতে চায়নি। আবার উল্টো করে ভাবলেতো এও বলা যায় বাবা তার আদরের লক্ষী মেয়েটির ইচ্ছা চাওয়াকে মূল্যায়ন করে নি। তাইতো দীপিকা নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছিল। বাবার দেয়া বিয়েটাকে সে মেনে নিতে পারেনি। বাবাকে সে এ বিয়ে থামানোর ব্যাপারে মানাতে পারেনি। দীপিকার সকল আব্দারকে উপেক্ষা করে দীপিকার বিয়েটা হয়ে যায়।

দীপিকার মা শুধু মেয়ের জন্য নীরবে চোখের জল ফেলেছে। বাঙালি মায়েরা নিজেরা যেমন বিয়ের আগে নিজের কথা বলতে পারে না বাবার ভয়ে তেমনি বিয়ের পর সন্তানদের কোন আব্দার জানাতে পারেনা স্বামীর ভয়ে। 

দীপিকার মনে তখন শাহেদকে ভাললাগার বীজটি রোপিত হয়েছে। মনের দোলদুলুনিতে ভালবাসার শাখায় দোল লেগেছে। একটা বিশ্বাস আস্থার দৃঢ়তায় শাহেদের প্রতি নির্ভরতা বেড়েছে। বন্ধু হিসেবে সারাজীবনের জন্য কাছে রাখতে ইচ্ছা করছে।

একদিন সময় সুযোগ বুঝে সাহস নিয়ে দীপিকা বাবাকে শাহেদের কথা জানায়। বাবা বিষয়টা আগেই আঁচ করেছিল। তাছাড়া যে গাড়িটায় দীপিকা ইউনিভার্সিটিতে যেতো সেটার ড্রাইভার নিয়মিত সব খবরই জানাতো রাশেদ সাহেব মানে দীপিকার বাবাকে। আর তাইতো এত দ্রুত বিয়ের প্রসঙ্গটা চলে আসা।

দীপিকার কথায় বাবা এতটুকু বিচলিত হলো না। শুধু বললো, শাহেদ আজ যে অবস্থানে একদিন আমারও এর চেয়ে দুর্বিসহ, দারিদ্রতায় দিন কেটেছে। দীর্ঘ রক্ত ঝরা পরিশ্রমের পর আজকের এই ব্যবসায় সফলতায় স্বচ্ছলতায় জীবন্যাপন। আর এর জন্য তোমার মায়ের ছিল অবিশ্বাস্যরকমের স্যাক্রিফাইস। একবেলা খেয়ে না খেয়ে, এক কাপড়ে,মাথার উপরে তখন আমাদের কোন

ছাদ ছিলনা, ততদিনে পৃথিবীতে তোমার আগমন, সন্তানের জন্য একটু ভাল খাবারের যোগান দেয়া, মায়ের সাধ পূরণে মেয়েকে একটু উন্নত পোষাক দেয়া সবই ছিল ধারাছোঁয়ার বাইরে । সেই ভয়াবহ দিনগুলির কথা আর মনে করতে চাই না। শাহেদের সাথে তোমার জীবন বাঁধলে তোমাকেও কষ্টকর জীবন বেছে নিতে হবে। তোমাকে আমি যেভাবে বড় করেছি, আমি কোনক্রমেই চাইনা কোন কষ্টের আঁচড় তোমার গায়ে লাগুক।

দীপিকা বাবার পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেললো। আর মনে মনে একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। তাইতো এনগেজমেন্টের আংটি আর বিয়ে পড়ানো হলেও দীপিকা তার সংসার জীবনে নিজেকে 

একাত্ম করতে পারেনি। দীপিকা লন্ডনে গিয়েও হোস্টেল লাইফে থেকে পড়াশুনা শেষ করেছে। একদিনের জন্যও আর শ্বশুর বাড়িতে ফিরে যায়নি। গ্র‍্যাজুয়েশনের কনভোকেশনে বাবা, মা, দীপন গিয়েছিল।বাবা মা অনেক অনুরোধ করেও তাকে শ্বশুর বাড়ি ফেরাতে পারেনি। মেয়ের জন্য বন্ধুর

কাছে এমনভাবে ছোট হতে হবে ভাবেনি। দীপিকা ডিভোর্স দেয়ার সব কাগজপত্র তৈরী করতে বললো ওর বাবাকে।মেয়ের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত রাশেদ সাহেব মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। আর এ আঘাতেই দেশে ফিরেই তিনি হার্ট এটাকে মারা যান। আর তখনই অতি দ্রুত দীপিকা দেশে ফিরে আসে।

চলবে....