মাতৃভক্তি

মাতৃভক্তি

জয় জ্যোতির্ময়

আমার মা বাংলা পড়তে পারে না। কোনোদিন স্কুলে যায়নি। তবে ছোটবেলায় কায়দা পড়েছিল বাড়িতে। তারপর কোরআন শরীফ। আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি-- মা প্রতিদিন বিকেলে কোরআন শরীফ পড়ে। শ্রুতিমধুর কণ্ঠে মা'র কোরআন শরীফ পড়া আমি শুনতাম মাঝে মধ্যে। 

           আমার মা স্কুলে পড়ুয়া না হলেও; মেধা ও মননে বাড়ির সবার প্রিয়। এখনো আমাদের বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে মা তাকে দেখতে যায় আর বারবার খোঁজ নেন। বলা যায়, প্রতিবেশী হিসেবেও মা সবার প্রিয়। তাছাড়া আমার মা একই পাড়ার মেয়ে ও বউ। তাই জন্ম থেকে এই গ্রামেই বড় হয়েছে। 

        একদিন রাতে আমরা সবাই বসে গল্প করতেছি। আমি মা'কে বলেছিলাম,মা, দেখো। কত সুন্দর চাঁদ! মা একপলক চাঁদের দিকে তাকিয়ে তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, চাঁদের চেয়ে সূর্য বেশি সুন্দর। অনেক ভালো। আমি কিছুটা অবাক হয়ে যায় মা'র কথা শুনে। সূর্য আবার ভালো হলো কেমনে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি। তারপর আমি মা'র কাছে কারণ জানতে চাই। মা বলতে থাকে,চাঁদের রাত সবসময় আসে না। কেবল কিছু সংখ্যক মানুষের কাছে(বিশেষ করে প্রেমিক-প্রেমিকা) চাঁদনি রাত ভালো। কিন্তু তুমি যদি এদেশের প্রতিটি কৃষককে বলো। তারা কিছু না ভেবেই বলে দিবে,সূর্যই ভালো আমাদের জন্য। চাঁদ তো রাতে ওঠে। তখন আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। আর সূর্যের আলো তো আমাদের ফসলের জন্য খুবই উপকারী বন্ধু। সূর্যের আলোয় ঝলমল করে সোনালি ফসল। সূর্যের আলো একদিন না পেলে ফসলের ক্ষতি হয় আর চাঁদের জোছনা সপ্তাহ না পেলেও ক্ষতি নেই। মা'র এ সুন্দর কথা শুনে আমি হতভম্ব হলাম। সত্যি তো! তারপর মা বলে,যদি কখনো সময় আসে; চাঁদ নয় সূর্য হবার চেষ্টা করবে। অন্যের কাছ থেকে আলো নিয়ে বাঁচার চেয়ে অন্যকে আলো বিলিয়ে বাঁচার মধ্যে একটা অন্যরকম প্রশান্তি আছে। 

   মা'র কথাগুলো শুনে আমার খুব ভালো লাগতো। জন্মদিনে পাওয়া উপহার ডায়েরিতে কথাগুলো লিখে রাখতাম। সেই ডায়েরিতে ছোট ছোট কবিতাও লিখতাম। আর সে ছোট কবিতাগুলো লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশ করতাম। তারপর ফেসবুক পেয়ে, ফেসবুকে নিয়মিত লেখালেখি চলছে। অনেক পাঠকও হয়েছে। কেউ কেউ আমার লেখাগুলো পড়ে আবৃত্তি করেও পাঠাতে থাকে আমার ইনবক্সে। একদিন আমার লেখা জন্মভূমিকে নিয়ে একটা কবিতা ফেসবুক বন্ধু আবৃত্তি করে পাঠায় আমার ইনবক্সে। আর আমার ভাতিজি মুন্নী সেই কবিতার আবৃত্তি মা'কে শুনান। মা পুরো কবিতার আবৃত্তি শুনে বলে। কথাগুলো খুব ভালো। জন্মভূমির প্রতি অগাধ ভালোবাসায় এমন কবিতার জন্ম দিতে পারে। আমার শহরের অনেক কথা আছে তাতে।

 একথা শুনে মুন্নী বলে, 'দাদী,জানো কে লিখেছে এটা?'

'না।'

'তোমার মেঝ ছেলে।'

'সত্যি!'

'হু' বলেই মুন্নী আবার আবৃত্তির ফুটেজ দেখায়।সেখানে আমার ছবিসহ নাম ছিল। 

দু'বছর পর মাকে নিয়ে লেখা একটা কবিতাকে আমার ছোটভাই গানে রূপান্তর করে। আমি নিজে মা'কে গানটা শুনাই। মা'র চোখের কোণে দুএক ফোঁটা জল লক্ষ্য করেছিলাম। গান শেষে মা'কে বলেছিলাম, আমার লেখা তোমার ছোট ছেলে গেয়েছে। মা'র মুখে হাসি দেখেছিলাম। খুব ভালো লাগে যখন মা'র মুখে হাসি দেখি। ইচ্ছে করে হাজার বছর মা'র হাসিমুখ দেখার জন্য বাঁচি।

      আমার একটা বইও বের হয়েছে। বইটি মা-বাবা'কে উৎসর্গ করেছি। বইয়ের প্রথম কপি মা'কে দিয়েছিলাম আর বলেছিলাম, 'আমার লেখা বই।' মা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছি, 'কলমটা সত্য পথে রেখো। মিথ্যে আবেগের ভালোবাসায় এত কালি ফুরিয়ো না। মনে রেখো- সত্যের জয় সুনিশ্চিত।'

       মা'র কথাগুলো শুনে মনে শক্তি পেয়েছিলাম। নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করি এমন মা পেয়েছি বলে। আমার জীবনে যদি কোনো ক্ষেত্রে সামান্য সাফল্য পাই তার মূলে মা'র ভুমিকা অনেক। মা আমার প্রথম শিক্ষিকা মা আমার প্রথম বন্ধু।