ঈদুল আযহা সংখ্যা ২০২০

ঈদুল আযহা সংখ্যা ২০২০

(গল্প)”অন্যরকম ঈদ”
                 শাহারা খান
               ************
        তখন ১৯৮৫ সালের আগষ্ট মাস।কুরবানী ঈদের আর কয়েকদিন বাকী।স্বাভাবিক ভাবে ঈদ নিয়ে বড়দের চেয়ে ছোটদের মনে আনন্দ থাকে বেশি।ভোরবেলা উঠে পুকুরে গোসল করা,নতুন জামা পড়া,হাতে মেহেদী লাগানো,ঈদ সালামী পাওয়া,দলবেধে পাড়াময় ঘুরে বেড়ানো।কিন্তু প্রতিবছরের মতো এবারের ঈদে আমার মাঝে সেইরকম কোন অনুভূতি নেই।এবার ঈদে শুধু এইটুকু চাওয়া,আব্বা যেন সুস্হ হয়ে যান।
             কয়েক মাস ধরে আব্বার শরীর খুব খারাপ।শ্বাস কষ্ট এবং কাশি খুব বেড়েছে।সিলেট শহরে বড় ডাক্তার দেখানো হয়েছে।কিছু ঔষধ পত্র দিয়ে ডাক্তাররা শান্তনা দিয়ে বাড়িতে সেবা করতে বলেছে।অর্থাৎ ডাক্তাররা বুঝে নিয়েছে আব্বা বাঁচবেন না।শরীরের ভিতরে হয়তো আরো কয়েকটা রোগ বাসা নিয়েছে।ছোট মানুষ আমি,এতকিছু বুঝিনাই তখন।
             আব্বা ছিলেন প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক।বাড়ির পাশে ঐ স্কুলটা ছিল আব্বার আত্মার সমান।স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ছিলো আব্বার কাছে সন্তান তুল্য।অসুস্হতার জন্য আব্বাকে স্কুলে যাওয়া বারণ করলেও উনি মানতে চাননা।প্রতিদিন স্কুলে যেতেন।আমার মনে আছে,কয়েক কদম হেটে গিয়ে আব্বা রাস্হার কোণায় বসে জিরিয়ে নিতেন।আমি আব্বাকে বই দিয়ে বাতাস করতাম।গ্রামবাসী অনেকে এসে আব্বার পাশে জরো হতো।সবাই বলতো মাষ্টার সাহেব আপনি ছুটি নেন।কিন্তু আব্বা বলতেন,স্কুলে না গেলে আমি শান্তি পাইনা।দোয়া করো আমি চাকুরীতে থাকাকালীন যেন আমার মরণ হয়।আমি পেনশনে যেতে চাইনা।স্কুলের প্রতি আব্বার টান দেখে,গ্রামবাসী অবাক হতো।এমন মাষ্টার খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
        কুরবানী ঈদের আগেরদিন বিকালে টেলিভিশনে হজ্জ অনুষ্টান প্রচার হতো।আব্বার খুব ইচ্ছা ছিল টেলিভিশনে হজ্জ অনুষ্টান দেখবেন।টেলিভিশনে হজ্জ অনুষ্টান শুরু হলো।আব্বা বিছানায় শুয়ে,শুয়ে দেখতে লাগলেন।কিন্তু তন্দ্রায় আব্বা চোখ মুজে ফেলছেন।উনার মধ্যে অনুষ্টান দেখার আগ্রহ নেই।
             আগামী কাল কুরবানী ঈদের দিন।রাতের বেলা ঘরের সবাই আব্বার কাছে একজন/দুইজন বসে,অন্যেরা রাতের খাবার খাচ্ছেন।খাওয়া কি হয় অসুস্হ রোগী ঘরে রেখে?শুধু পেটে একটু দেয়া।আমি আব্বার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছি।মনে হচ্ছে আব্বা অনেক আরামে ঘুমাচ্ছেন।মনে,মনে ভাবছি আব্বাকে আগের দিনের চেয়ে সুস্হ মনে হচ্ছে।আল্লাহর রহমতে আগামী কাল খুশির ঈদ করবো।রাতে পাশের ঘরের দুই চাচা এলেন প্রতিদিনকার মতো আব্বাকে দেখতে।তিনারা আব্বার গায়ে হাত দিয়ে আম্মা আর বড় ভাইকে কানে,কানে কি বললেন,তারা তো কান্না শুরু করে দিলেন।আমাদের শান্তনা দিয়ে বললেন,তোমরা পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করো।তিনি শেষ ঘুম ঘুমাচ্ছেন।চাচারাও আমাদের পাশে বসে দোয়া দরুদ করতে লাগলেন।
শেষ রাতের দিকে আব্বার অবস্হা খারাপ হতে লাগলো।জুরে,জুরে শ্বাস নিতে লাগলেন।ঐদিন ২৭শে আগষ্ট ঈদ-উল আজহার দিন ভোর ৩টার সময় আব্বা চলে গেলেন অপারে।ঈদের জামাতের পর পারিবারিক গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
        ঈদ মানে আনন্দ,ঈদ মানে খুশি।প্রতি বছর ঈদ আসে মুসলিম উম্মাহর মাঝে আনন্দ বিলিয়ে দিতে।ক্ষনস্হায়ী দুনিয়া থেকে আমরা সবাই 
এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেবো।কিন্তু এমনও আনন্দের দিনের সাথে জড়িত,এতবড় দুখের স্মৃতি সহজে কি ভুলা যায়?তাই প্রতি বছর ঈদ-উল আজহা আসলে কান্নায় বুক ভাসে।আল্লাহ আমার আব্বাকে জান্নাতবাসী করুন।L