গল্প

গল্প

স্মৃতিচরণ
-মোরশেদা পারভীন

কুরবানী ঈদ যতটা আনন্দের হয় বিয়ের আগে ততটা আনন্দ কিন্তু বিয়ের পর হয় না। কারণ বিয়ের পর সাংসারিক অনেক দায়িত্ব এবং কাজ থাকে। রান্নার কাজ শেষ করে, পরিবারের সবাইকে খেতে দিয়ে তবে গিয়ে নিজের জন্য সময় হয়। আর সে সময়টুকুও নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না কারণ আত্মীয় স্বজনের যাওয়া আসা তো থাকবেই। সেগুলো মেইনটেইন করতে হয় বাড়ির গিন্নীকেই।

আমি গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছি। বাচ্চাদের উন্নত লেখাপড়ার জন্য। বাচ্চাদের লেখাপড়ার চাপের কারণে গ্রামে তেমন একটা যাওয়া হয়ে ওঠে না। স্কুল প্রাইভেট সব মিলিয়ে সময় হয়ে ওঠে না। আর গ্রামে কেউ নেই, শুধু বাড়ি ছাড়া। আমার স্বামীর যখন মোটে পাঁচ বছর বয়স তখন আমার শশুর মারা যায়। তারপর স্বামী কলেজে তখন তার মা মারা যায়। আমার ননদ ভাসুর আছে কিন্তু ওনারা সবাই বড়। আমার স্বামী সবার ছোট। ননদ'দের তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে আর ভাসুরেরা বিয়ে করে বাচ্চাদের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে তারাও শহরে চলে এসেছে।
আমরা গ্রাম থেকে চলে আসার পর বাড়ি একদম  ভুতড়ে বাড়ির মত হয়েছে। মাঝে মাঝে যদিওবা কাজের ছেলেমেয়েরা পরিষ্কারের কাজ করে। তবে কেউ না থাকলে সে বাড়ি যতই পরিষ্কার করুক না কেন তেমন একটা পরিষ্কার বহাল রাখা সম্ভব হয় না।

শহরে থাকার কারণে গ্রামের বাড়িতে  যাওয়ার জন্য আমরা ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি। ঘুম থেকে উঠে গোসল করে রেডি হই সবাই। ফজরের নামাজ পড়ি তারপর আমাদের গাড়িতে করে আমরা গ্রামের বাড়িতে রওয়ানা হই।
মজার বিষয় হলো, আমার পরিবার শুধু একা গ্রামে যাই তা নয়। আমার বড় ভাসুরের পরিবারও আমাদের সাথেই যায় আমাদের গাড়িতে। একসাথে আমরা রাস্তায় অনেক মজা করি। সাথে বাচ্চাদের দুষ্টমি তো আছেই। কে কাকে কত বেশি বিরক্ত করতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলে পুরো রাস্তায়। 

আমার চাচা শশুরের ছেলেরাও শহরে থাকে। ঈদের দিন তারাও গ্রামে আসে।  গ্রামে পৌঁছে ছেলেরা নামাজে চলে যায় আর আমরা মেয়েরা সবাই সবার বাড়িতে গিয়ে একজন আরেকজনের সাথে দেখা করি।

আরেকটা মজার এবং আনন্দের বিষয় হলো ঈদের দিন আমাদেরকে কোনো কাজ করতে হয় না। শুধু খাওয়া-দাওয়া আর সবার বাড়িতে ঘুরে বেড়ানোই যেন কাজ। বেশ মজার এবং আনন্দপূর্ণ  মূহুর্ত সময় কাটাই আমরা।

আমরা ঘুরতে চলে গেলে, এদিকে কাজের মেয়েরা মাংসের যাবতীয় কাজ সম্পূর্ণ করে রেখে চালের গুড়োর  রুটি এবং হালুয়া তৈরি করে । রুটির কাজ পরে করার কারণ হলো মাংস আসলে যেন খুব দ্রুত সেগুলো তুলে দেওয়া যায়।
আর পাঁচ-ছয় জন মহিলা একসাথে কাজ করে বলে কাজও তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।

নামাজ শেষে গরু-খাসি আল্লাহর নামে কুরবানী হয়ে গেলে। দশের ভাগ এবং আত্মীয় স্বজনের ভাগ মেপে আলাদা করে, বাড়িতে মাংসে নিয়ে আসে ছেলেরা। সেগুলো ভালো করে ধুয়ে বড় বাঁশের ডালার মধ্যে আধা ঘণ্টা রেখে দেয় পানি ছড়ার জন্য। 
আরেকটা মজার বিষয় হলো আমরা একটাও কাঁচা মাংস ফ্রিজে রাখি না। কুরবানীর পুরো মাংসটা রান্না করে নেওয়া হয়।
বিয়ে বাড়িতে বা কোনো বড় অনুষ্ঠানে যেমন মাংস রান্না করা হয় ঠিক তেমন করে আমাদের কুরবানীর মাংসও রান্না করা হয়। আর সে মাংস ছেলেরাই রান্না করে। কারণ এত বড় বড় হাঁড়ি ধরার শক্তি মেয়েদের নিশ্চয়ই নেই।
মাটিতে ইট দিয়ে বড় বড় দুইটা চুলা করা হয়। সেখানে দুই দিকে খুব তাড়াতাড়ি রান্নাও হয়ে যায়। কারণ মাংস আসার আগে থেকেই সব কিছু রেডি থাকে।

তারপর মাংস রান্নার শেষের দিকে সবাই চুলা থেকেই রুটি দিয়ে খাওয়া শুরু করে দেয়। মাংসটা এত মজা হয় সে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। রান্না শেষে মাংসগুলো ফ্যানের নিচে দিয়ে ঠাণ্ডা করা হয়। বিকেল হয়ে গেলে সবাইকে খাইয়ে এবং সবার সাথে বিদায়ের জন্য দেখা করে শহরের উদ্দেশ্য রওয়ানা হই।

আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ঈদ করার জন্য ঈদের দিন বিশেষ কোনো আলাদা খাবারের  আয়োজন করা হয় না। তবে বাসায় ফিরে রান্না করা মাংসগুলো বক্সে বক্সে ডিপফ্রিজে ফ্রিজাব করা হয়। এবং পরের দিন বিশেষ রান্না করে খাওয়া হয়।

তবে এটা যে শুধুই বিগত স্মৃতি তা নয় কারণ আসছে আগামী ঈদেও একইভাবে গ্রামে ঈদুল আযহার জন্য যাব ইনশাআল্লাহ। 
স্মৃতিগুলো থাকুক সযত্নে এবং আগামীর দিনেও জমা হবে এমন নতুন স্মৃতি। হয়তো'বা  আরও সুন্দর এবং মধুর স্মৃতি!